রান্নাঘর আর বাইরে

পূর্বা মুখোপাধ্যায়
ঘর আর বাইরে , মেয়েদের একটা অংকের নাম। যে যত এই অংকটা রপ্ত করতে পারে, সে তত কনফিডেন্ট ও একটু জাঁদরেলও বটে। তাদের কেউ চট করে জব্দ করতে পারে না। সব হোম টাস্ক সে করে ফেলে। অবশ্য কতটা ভেতরে পোড়ে, ভাঙে, ভাসে সেই জানে। তবে প্রকাশে আনে না। পেয়ে বসবে দুনিয়া।
এই গল্পটা মালবিকার। বিজয়গড় পাড়ায় মালবিকা তখন ছিলেন একদম আলাদা। সে সাধারণ বাংলার গ্র্যাজুয়েট হয়েও এই অংকে পাকা। আমরা বলতাম মালবিকা মাসি। আমাদের মায়েদের মালবিকাদি। আসলে, আমার মা, এবং আমার যাবতীয় পাড়ার বন্ধুদের সবার মায়েদের আদর্শ ছিল মালবিকা মাসি।মাঝখানে অনেকগুলো দিন কেটে গেলেও ,বিজয়গড়ে তখনও দেশভাগের দাগ দগদগে। পরিবার গুলো মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই পেলেও পুরোটা গুছিয়ে নিতে পারে নি। তখনও পাড়ার মুদির দোকানে খাতা , আর তাগাদা; পাল কাকিমা ছোটো ছেলেকে হর্লিক্সের শিশি দিয়ে দোকানে পাঠায় দুশো সর্ষের তেল আনতে। পাড়ার বিনি দি হরিণঘাটার দুধের গুমটিতে কাজ করে ছোটো ভাইয়ের পড়ার খরচ যোগায়; সন্ধেতে টিউশানি করে। অনেক বাড়িতেই মেয়েদের তখন ঘরের বাইরে পা দিতে হয়েছে।
নিখিলেশের একান্ত ইচ্ছা ছিল, বিমলাকে অন্দরমহল থেকে বাইরে আনেন; শুনে বিমলা বলেছিল – বাইরেতে আমার দরকার কী? নিখিলেশ বলেছিল, তোমাকে বাইরের দরকার থাকতে পারে| তারপরই সেই বিখ্যাত উক্তি – “ আমি চাই বাইরের মধ্যে তুমি আমাকে পাও, আমি তোমাকে পাই | “ কথার মতো কথা বটে! রবি ঠাকুর ছাড়া এ ভাবে ভাবতে পারত কেউ? পারে, এখনও? তবে ব্যাপারটা হল এই যে এসব কথা “কোট” করে প্রেমপত্তরে তাকে ইম্প্রেস করলেও, বিবাহোত্তর সীনটা ভিন্ন| গড়পড়তা পাঁচটা স্বামী স্ত্রী এই সব কথা বলেন না| তেনারা ঝগড়া করেন , কথায় কথায় একে অপরকে দোষ দেন – তোমার জন্য জীবনটা ভাজা ভাজা হয়ে গেল গো! আর মিটমাট হয়ে গেলেই স্বামী বাজার থেকে ভালো চিংড়ি আনেন, অথবা ভালো চিংড়ি আনলে মিটমাট হয়ে যায়| আর সাথে আবার লাউ আর পুঁই দুটোই, এবং বলেন তোমার তো আবার পুঁই চিংড়ি বেশি পছন্দের, ওটাই কর| লাউ দিয়ে ডাল কোরো বরং , তিতার ডাল| এই সব বাড়িকে বলে গেরস্ত বাড়ি| এইসব গেরস্ত বাড়িতে বহুকাল যাবৎ মেয়েরা ঘরের লক্ষ্মী; তাঁরা প্রভুত পরিমাণে যত্ন আত্তি করে ছেলেদের একেবারে স্পয়েল করে , খাইয়ে -দাইয়ে, এবং তারপর চার ডবল,গজগজ করে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে প্রমাণ করেন | তাদের ডায়লগগুলো টেস্টপেপারের কোশ্চেনের মতো কমন , সব বাড়িতেই – আমি ছিলাম তাই এ যাত্রা তরে গেলে! আমি না থাকলে কে এসব রান্না করে খাওয়াত , শুনি? যেদিন থাকব না সেদিন সব বুঝবে, ইত্যাদি।
তা এইসব গেরস্তবাড়িতে কেবল ঘরে নয়, বাইরেও চিরটাকাল এই রমণীরাই উদ্ধার করেছে| দেশও| হ্যাঁ, একটা সময় পর্যন্ত আড়াল থেকেই, দরকারে পর্দা ফর্দাফাঁই করে বাইরে এসে |
কেবল এই ভারতবর্ষ নয় , গোটা ব্রহ্মাণ্ড জুড়েই এই খেলা| গোড়ার সেই গুহা টুহায় , জঙ্গল টঙ্গলে থাকার সময় মেয়েরা তো সর্বেসর্বাও ছিল| কী প্রতাপ! তাকে পাওয়ার জন্যে কী কাড়াকাড়ি! ঘোড়ায় চড়া, তীরধনুক, তরোয়াল দিয়ে মুন্ডু ঘচাং ফু:! মেয়েরা কী না পারত! আবার এক সময় ঘুরে গেল চাকা, যেমনটা হয় ,ইতিহাসের, সমাজের| মেয়েরা আবার ঘরের ভেতরে | তবে তখনো বাইরে তার প্রভাব কিছু কম ছিল না| যুদ্ধু কেবল হেলেন বা দ্রৌপদীর জন্যেই হয় নি, নুরজাহানের জন্যেও খামোখা মরে যেতে হল শের আফগানকে|
সে সবও একদিন ইতিহাস বই হয়ে গেল, তবে ওই নারী চ্যাপ্টারটা প্রতি বছরই সিলেবাসে সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট | এমন কি বিলেতেও| বিশ্বযুদ্ধ হল অমনি নাটক, নভেল, কবিতা, সিনেমা, ছবি সব বেরোতে লাগল যুদ্ধের পরে নারীদের জীবন নিয়ে| সাজ পোশাক, চুল কাটা, আপিস টাপিস, রান্না খাওয়া সব| প্রথম দিকে কিছুটা প্রগতি, কিছু নকল এই ছিল মেয়েদের বাইরে পা| মোট কথা ওই অপশনাল সাবজেক্ট| ইচ্ছে হলে নিতে পারো| তারপর এই বঙ্গদেশেও এমন যুগ এল ,যখন মেয়েরা কেবল সংসারের জন্যই, ঘর সংসার ছেড়ে বাইরে পা দিল| ওই যে সংসার সুখের হয় বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস!
তখন নরেন্দ্রনাথ মিত্রের অবতরণিকার আরতি অনেক ছিল| বিজয়গড়ে, যাদবপুরে, টালিগঞ্জে, বেলেঘাটায়, দমদমে| নাম আলাদা ছিল | এরা মহানগর, মেঘে ঢাকা তারা, তপস্যা এইসব সিনেমার ভক্ত ছিল| লেখাপড়া শেষ করে স্টেনো, শর্টহ্যান্ড, টাইপিং, টেলিফোন অপারেটিং ,নার্সিং এসব চাকুরিতে ঢোকা| সেই শুরু| ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর| সূচনা ঘরের ভেতরে বাইরের হাওয়া আসা। সংসারের সব কাজ সেরে ছেলেদুটোকে স্কুলে পাঠিয়ে চুলটাকে শক্ত করে একটা খোঁপায় বেঁধে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়া| লিপ্সটিক কাজল তো অভাবনীয়|
মালবিকা ছিলেন এই আরতি গোত্রের। বেশি রঙচঙে শাড়ি পরতেন না কস্মিনকালেও। চুলে হয় খোঁপা , নয় এক বিনুনি। কাঁধে সস্তা নকল লেদারের ব্যাগ, হাতে সরু চুড়ি আর বাঁ হাতে লোহা আর লেডিস ঘড়ি। অনেকে আবার ডান হাতেও ঘড়ি পরা ধরেছিল, সিনেমা-টিনেমা দেখে। বাড়ির বড়রা, পাড়ার গিন্নিরা, শাশুড়িরা এদের খুব নিন্দে করত; তবে সব বাড়ির তরুণী দল ছিল মালবিকার ভক্ত। নতুন বৌরাও। পুরোনো বৌরা মনে মনে চেয়েছিল ও রকম হতে কিন্তু পারে নি, তাই একটু হিংসে-টিংসে করে ফেলত। অনেক বাড়িতেই মালবিকা বৌদি এই ভাবে শাড়ি পরে, ঐভাবে চুল মাখে, মুখে নারকেল তেল মাখতে বলেছে, স্কিন ভালো হয়, কাঁচা মুগের ডালে রাঁধুনি ফোড়ন দেয়, বেগুনের মধ্যে রসুন-লংকা ভরে দিয়ে পোড়ায়, এই সব অক্ষরে অক্ষরে পালিত হত।
সত্যিই কী অসম্ভব কর্মঠ ছিলেন, আর কী এফিসিয়েন্সি লেবেল। সোজা ছিল না জীবনটা মোটেও। তিন কামরার বাড়িতে সতেরো জন। শ্বশুর-শাশুড়ি তো ছিলেনই; যদিও তাঁরা এই প্রেমের বিবাহে যথেষ্ট আপত্তি জানিয়েছিলেন,আর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে মালবিকা আর অরুণ এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু মাস খানেক পরে একে একে সবাই, মানে বাকি পনেরো জন এসে পড়ল।বিবাহিতা কিন্তু স্বামীর চাকরি নেই, অতেব থাকো ছেলে-মেয়ে সহ, এমন ননদ, এলেন; অবিবাহিতা ননদ, মোটেও মহানগরের জয়া ভাদুড়ির মতো নয়, খালি সাজ আর অন্তুর সাথে ‘চোখে চোখে, আহ, কথা বলো’ এবং ফলস্বরূপ,আনএন্ডিং ক্লাস এইট ; দুই দেওর। একজন বিবাহিত; তার বৌও অবশ্য চাকরি করেন; কিন্তু সব দায়িত্ব মালবিকার ওপরেই। অনেক খেয়াল রাখতে হয়। আলু-পেঁয়াজ সব গুনে গুনে, মাস গেলে রোজগারটাও তো গোনা। ময়দা-তেল-ঘি –চা-চিনি কিছু বেশি এনে জমিয়ে রাখার উপায় নেই; তার অবর্তমানে পরোটা হবে, চা হবে, ডিমের মামলেট এসব। কাজেই চাই স্ট্রিক্ট ডিসিপ্লিন; অথচ কারো অযত্ন নয়; সবাই পেট পুরে খাবে; কেউ কাউকে বঞ্চিত করা নয়; কারো ভাগেরটা কেউ খেয়ে নেওয়া নয়। বাইরের চাকরিটা সামলে এগুলো দেখতে দেখতে নিজের সময়টা আর থাকত না। তা মাথা ঘামালে চলে মালবিকার? সংসারের লোকগুলো তো সব নিজের। আর অভিজ্ঞতা দিয়ে মালবিকা দেখেছে, রান্নাঘর ম্যানেজমেন্টটা ঠিক চললে বাকি সংসার বিদ্রোহ বিক্ষোভ করে না। বাকি রইল , টুকটাক আজ কার মশারি টাঙানোর পালা, কে কাপড় কাচে নি, সে সব মিটে যায়।
এই সতেরো জনের ফ্যামিলির সব্বাইকে সেটল করিয়ে মালবিকা, ঢাকুরিয়াতে বাড়ি করলেন। ছেলে ইঞ্জিনীয়ার, মেয়ে প্রফেসর। ঘর-সংসারের অত কাজের মধ্যেও কিন্তু সেই শুরুর স্ট্রাগলের দিন থেকেই এক ঝাঁক বান্ধবীদল ছিল মালবিকার। এরা বাইরের জগতের, মানে আপিসের। সবাই তাঁরা সংসারের হাজার বায়নাক্কা সামলান, কর্মক্ষেত্রে লক্ষ পলিটিক্স নিয়ে গজগজ করেন, তার মধ্যেই উজ্জ্বলায় শ্বেত পাথরের থালা দেখে আসেন। তদ্দিনে একটু থিতু হয়েছেন সবাই। একবার পুরী যাওয়া হয় , আর একবার শান্তিনিকেতন। মালবিকা মাসি আরো ব্যক্তিত্বময়ী আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। কারো ছেলের বউ সংসার আর আপিস নিয়ে হিমশিম এই বলে গজগজ করলেই, কোনো আহ্লাদী মেয়ে বিয়ের পর তার চাকরি-বাকরি নিয়ে শ্বশুরবাড়ির সংবেদনশীলতার অভাব, এবং অন্যায্য ডিমান্ড নিয়ে মায়ের কাছে গুজুর গুজুর করতে এলেই, মালবিকা মাসির বান্ধবীরা অবধারিত বলেন – তোমরা এতেই অধৈর্য হলে! মালবিকার কথা ভাবো তো একবার!
মালবিকা দেখেন নি; কিন্তু তিনি জানেন মেয়েরা, বৌরা নিশ্চই মুখ বেঁকায়, আড়ালে, বলে, ঐ শুরু হল, এক পাঁচালি। মালবিকার এখন অনন্ত অবসর। তিনি ভাবেন। সময়টা তাঁদের আলাদা ছিল; তবে ঘরে-বাইরে দু জায়গায় পা দেওয়া মেয়েদের অবস্থা একই, ছিন্নভিন্ন হতেই হয়; এখনও সংসারের জন্যই যাবতীয় কাজ, নইলে বাইরেতে কী প্রয়োজন? তাও নালিশ জমে, বিক্ষোভ দেখা দেয় কথায় কথায়, কী কী হয় নি! পান থেকে চুন খসা ক্ষমার অযোগ্য। এখনো ল্যাজে গোবরে, হিমশিম সব এই ঘরে বাইরে শাটল কক মেয়েগুলোই।
মালবিকা ছাদে বাগানে যান; হলুদ গাছ পুঁতেছেন। পাতা তুলে আনেন। এ রেসিপি এক অ্যাংলো সহকর্মীর কাছে শেখা, অফিসে। মহানগরের এডিথের মতই, রোজেলীন। শিখিয়েছিল স্মোকড ফিশ; আশ্চর্য, ঠিক আমাদের পাতুরির মতই তো অনেকটা! ভেবেছিল মালবিকা। ভেটকি মাছের ফিলেতে নুন, হলুদ সর্ষে বাটা, সর্ষের তেল ,লেবুর রস সামান্য, কাঁচা লংকা সব মেখে বেশ কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে। তারপর এক একটা হলুদ পাতা নিয়ে তার মধ্যে এক একটা মাছের টুকরো পুরে পাতা মুড়ে তেল মাখানো চাটুতে বসিয়ে দেওয়া। পাতা একদম পুড়ে বর্ণহীন হোক। গন্ধেই মাতোয়ারা হবেন। শেষে রুটি সেঁকার জালি নিন। পাতায় মোড়া মাছ সাজান, পাশে একটু মোটা মোটা চাকা চাকা করে কাটা পেঁয়াজ আর টমেটো। ডিরেক্ট গ্যাসের ফ্লেমের ওপর ধরে পুড়িয়ে নিন। পাতা থেকে মাছ বের করে নিন আর ঐ গ্রিলড পেঁয়াজ-টমেটো সহযোগেই পরিবেশন করুন – স্মোকড ফিশ।
সন্ধেবেলায় ছেলে আর ছেলের বৌয়ের বন্ধুরা আসে, জানতেন মালবিকা। তাই এই রান্নাটা করলেন, রোজেলীনের ডায়েরী থেকে। সুপার হিট। “খাও তোমরা, এঞ্জয় করো” বলে নিজের ঘরে চলে যান মালবিকা। ছবি তুলে রেখেছিলেন। গ্রুপেও পাঠান; তাদের একটা গ্রুপ আছে , ঘরে-বাইরে ল্যাজে গোবরে। ঐ গ্রুপে রোজেলীনও আছে, সে কানাডায় থাকে এখন, মেয়ের কাছে। পাশের ঘরে মাছ খেতে খেতে আহা উহু করা পুত্রবধূর বান্ধবীর গলা পাওয়া যায় – “ইউ আর সো লাকি টু হ্যাভ আ শাশুড়ি লাইক দিস ইয়া……”
বড্ড ভীষণ ভালো লিখেছো গো মুখুজ্জে গিন্নি , আর শেষের রেসিপি টাও অসাধারণ ।
দারুন গল্প সাথে কলাপাতার বদলে হলুদ পাতা রেসিপি👌🏼👌🏼
Ei lekha pore amar sasuri ke dekhlam.. 42 bochhor Calcutta Telephone e kaaj kore retired hoyechhen sodyo… tNar o dui chhele ar ojosro bandhobi, jara eksathe puri jay, Kashmir o, ekhono…