শান্ত হোক শান্ত হোক

চান্দ্রেয়ী চক্রবর্তী গোস্বামী
আমরা যারা কলকাতায় স্কুলে পড়েছি আর হাই স্কুলের পর আর ইতিহাস পড়িনি, তাদের কাছে ইউরোপের ইতিহাস বলতে যেগুলো সবচেয়ে আগে মনে আসে সেগুলো ফরাসি বিপ্লব, নেপোলিয়ান আর হালের দুটো বিশ্বযুদ্ধ। ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের কথা মনে করলে যুদ্ধের চেয়ে বুদ্ধের শান্তির বাণীই বেশি মনে আসে, অন্তত আমার আসে। সেই তুলনায় ইউরোপের ইতিহাসের পাতা অনেক রক্তক্ষয়ী। তারপর যারা আশি নব্বই এর দশকে বড়ো হয়েছে তাদের কাছে খুব পরিচিত ছিল কোল্ড ওয়ার, সোভিয়েত রাশিয়া তারপর পেরেস্ত্রাইকা আর গ্লাসনস্ট। রাশিয়া ছাড়া পূর্ব ইউরোপের বাকি দেশগুলোর ব্যাপারে আমরা সামান্যই জানি। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাবার পর কতগুলো আলাদা দেশ তৈরি হয়েছে, তাদের নাম কি, সেসব বহু লোকই জানেন না, জানার প্রয়োজন ও রোজকার জীবনে হয় না। আমাদের দেশের খবরের কাগজের বিদেশ বিভাগ গুলো মূলত আমেরিকার খবরেই ভর্তি থাকে, আর আমাদের কলোনিয়াল লেগাসি মেনে ব্রিটেনের। বাকিটা পাকিস্তান, আফগানিস্তান আর চীন। এমনকি সাধারণ ভাবে ইউরোপ বলতেও আমরা ওই ইংল্যান্ড ফ্রান্স জার্মানি ইতালিই বুঝি। বড়জোর নরওয়ে, সুইডেন। পূর্ব বা মধ্য ইউরোপ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান বড্ড সীমিত, বহু লোকই মল্ডোভা বলে যে একটা দেশ আছে, তাও জানেন না। যেহেতু এশিয়া আর ইউরোপ কোনো বড়ো সমুদ্র দিয়ে আলাদা নয়, ঠিক কোন জায়গা থেকে এশিয়া আর ইউরোপের মানুষের রীতিনীতি সভ্যতা ভাষা আলাদা হলো বলা খুব মুশকিল।
ইউরোপের একেবারে কেন্দ্রস্থলে একটা দেশ চেক রিপাবলিক, সোভিয়েত আমলে ছিল চেকোস্লোভাকিয়া, ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে ভেলভেট রেভোলুশন এর মাধ্যমে তারা কমিউনিস্ট শাসন থেকে বেরিয়ে আসে এবং চেক ও স্লোভাক রিপাবলিক বলে দুটো আলাদা দেশ তৈরি হয়। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো একবিন্দু রক্ত খরচ না করে এই বিপ্লব হয়। চেক রিপাবলিক দেশটার একটা অবস্থানগত সুবিধা হলো তথাকথিত পশ্চিম ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ এবং তুর্কি সব জায়গা থেকে মোটামুটি দুই থেকে সাত আট ঘণ্টার মধ্যে স্থলপথে যাতায়াত করা যায়। আর একটা ব্যাপার হলো, এরা অন্য ইউরোপিয়ানদের তুলনায় অনেক শান্তিপ্রিয়। এরা নিজেরা বলে, সেই অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান সময় থেকে শুরু করে পরে জার্মান, শেষে রাশিয়ানদের অধীনে থাকতে থাকতে এরা বড়ো নিস্পৃহ হয়ে গেছে। মোটামুটি খেয়ে পরে থাকতে পারলেই খুশি।
তো এহেন দেশটা কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙার পর থেকে পূর্ব থেকে পশ্চিম ইউরোপে প্রাচুর্যের সন্ধানে যাওয়া বহু মানুষকে জায়গা দিয়েছে, সাহায্য করেছে তাদের পশ্চিমে পাড়ি দিতে। ফলে ভালো করে দেখলে দেখা যায় চেক রিপাবলিকে যে কোনো প্রতিষ্ঠানে যতজন চেক প্রায় তত জন সম্মিলিত ভাবে স্লোভাক, পোলিশ, ইউক্রেনিয়ান, রোমানিয়ান এমনকি রাশিয়ানও। গত সাত আট বছর ধরে ইউক্রেনের অবস্থা খারাপ। দেশের ভেতরে বিভিন্ন দিকে নিজেদের মধ্যে মারামারি, নিও নাৎসি দের বাড়বাড়ন্ত। তাই বহু লোকই দেশ ছেড়ে ইউরোপের অন্য দেশ গুলোয় এমন কি কানাডাতে চলে গেছে ও যাচ্ছে। সেই জন্য চেক রিপাবলিক, পোল্যান্ড এই সব দেশে ট্যাক্সি চালানো থেকে শুরু করে ঘর পরিস্কারের লোক, রাজমিস্ত্রি থেকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, এদের বিরাট অংশ ইউক্রেনিয়ান। চেকরা খুব শান্তশিষ্ট হলেও হয়তো কমিউনিস্ট সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য রাশিয়ান দের একেবারে পছন্দ করেন না। গত সাত আট বছর ধরে দেশটা তে প্রচুর ইউক্রেনিয়ান যেমন এসেছে, তেমন গত দু তিন বছরে এসেছে তুর্কিরা। এই ইউক্রেনিয়ানরা চেকদের তুলনায় অনেক হাসিখুশি ও হুল্লোড়ে। চেক রিপাবলিক দেশটায় বিশেষ করে প্রাগে প্রচুর ভারতীয়ও আছেন। আর আছেন ভিয়েতনামীরা। আমেরিকা ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় বহু ভিয়েতনামী রিফিউজিকে তৎকালীন কমিউনিস্ট সরকার এ দেশে জায়গা দিয়েছিল। এখন তারা এ দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। প্রায় সমস্ত মুদির দোকান আর সেলুন ভিয়েতনামীদের। অর্থাৎ চেক রা বাইরে কাঠখোট্টা নির্লিপ্ত হলেও আসলে বেশ বন্ধুবৎসল।
এই রকম একটা পরিস্থিতি তে কদিন আগে রাশিয়া ইউক্রেন-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। আসলে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নয়, অন্তত রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বক্তব্য অনুযায়ী ন্যাটোর বিরুদ্ধে। এখন চেক রিপাবলিক অবধি পূর্ব দিকের দেশগুলো এমনকি তুর্কিও ন্যাটোর মেম্বার, যদিও চুক্তিতে ছিল ন্যাটো পূর্ব দিকে বিস্তার করবে না। কিন্তু এসব গুরুগম্ভীর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যাপার কখন কোন দিকে মোড় নেবে সেব্যাপারে ঐতিহাসিকরাও ঠিক করে বলতে পারেন না। ফলে আমরা যেটা দেখছি তা হলো প্রায় তিন বছর ধরে কোভিডের কারণে চলা ভোগান্তি থেকে যখন মানুষ একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে ভাবছে, তখনি ক্ষমতাশালীরা যুদ্ধ বাধিয়ে বসে রইলেন। সাধারণ মানুষ এখন তার রোজগারের খাওয়া পরার চিন্তা ছেড়ে পারমানবিক বোমায় কত মানুষ মারা যেতে পারে সেই নিতে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।
কিন্তু এসবের পাশাপাশি আরেকটা জিনিস দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রনায়করা, ক্ষমতাশালী কিছু মানুষ যতই নির্বুদ্ধিতা দেখাক না কেনো, অমানবিক আচরণ করুক না কেনো, সাধারণ মানুষ কিন্তু সংযত ও দয়াশীল। কিইভ থেকে প্রাগে র দূরত্ব মোটামুটি চোদ্দশো কিলোমিটার। যুদ্ধ ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে রিফিউজি মানুষের ঢল আসতে শুরু করলো পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়া হাঙ্গেরি আর চেক রিপাবলিকে। সকাল থেকে রাত বেশ কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপ, যেমন ইন্ডিয়ান লাভলি লেডিজ থেকে শুরু করে এক্সপার্ট ওমেন ইন প্রাগ সব জায়গায় দেখছি মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে রিফিউজিদের হেল্প করছেন। কেউ নিজের বাড়ির ঘর ছেড়ে দিচ্ছেন, কেউ কেউ গ্রুপে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আমার বাড়িতে এক ইউক্রেনিয়ান ফ্যামিলি আজ রাত থেকে থাকবে, ব্রেকফাস্টে ওদের জন্য কি বানালে ওরা বেশ নিজেদের বাড়ি মনে করবে’? চেক রিপাবলিকের পূর্ব দিকের শহর গুলোর চার্চে, হাসপাতালে সব থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। এত ঠান্ডা! সবাই সোয়েটার কম্বল এসবের ব্যবস্থা করছেন। চার্চে লেন্ট শুরু হবার দিনের প্রার্থনায় যুদ্ধে বিদ্ধস্ত মানুষের জন্য বিশেষ প্রার্থনা করা হচ্ছে। টাকা পয়সা জোগাড় করা হচ্ছে। এর মধ্যে খবর পাচ্ছি ভারতীয় ছাত্ররা আটকে পড়েছে ইউক্রেনে। আবার সেখানে ভারতীয়, পাকিস্তানি, তুর্কি, আফ্রিকান ছাত্ররা মিলেমিশে একসাথে সবাই সবাই কে সাহায্য করছেন। পরিচিত লোকজনদের থেকে খবর পাচ্ছি খারকোভ, কিয়েভ, মারুইপল থেকে ছেলেমেয়ে গুলো বেরোতে পারলো কিনা। বর্ডারে চেক রিপাবলিকের ভারত সংঘ ওঁদের খাবারের ব্যবস্থা করছেন। সবাই সব সময় এই একই আলোচনা করে চলেছেন। ট্রামে বাসে অফিসে সর্বত্র। কিন্তু তার সাথে সবাই যে যেমন করে পারছেন সাহায্য করছেন।
প্রাগে দুদিন বিশাল সমাবেশ হলো যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি চেয়ে, ভাবাই যায় না এত বড়ো সমাবেশ, এই ঠান্ডায়! এর মধ্যে একটা খারাপ ব্যাপার হলো সাধারণ রাশিয়ান যারা যুদ্ধ সমর্থন করছেন না তারাও কিন্তু শুধুমাত্র রাশিয়ান বলেই জনরোষের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়েছে কোনোভাবে রাশিয়ান ছাত্র বা শিক্ষকদের যেন অসুবিধা না করা হয়। প্রায় সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান এর বিভিন্ন জায়গায় বাংকার আছে। সেসব যাতে কেউ চাইলে ভাড়া নিতে পারে সেই ব্যাপারেও সেই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ইমেইল করা হয়েছে। বিখ্যাত Humboldt ফাউন্ডেশন ইউক্রেনিয়ান সাইন্টিস্টদের জন্য বিশেষ ফেলোশিপ এর ব্যবস্থা করেছে আগামী তিন বছরের জন্য। চেক রিপাবলিক সহ প্রায় সব ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশ ভিসা ছাড়া সেই দেশে ইউক্রেনিয়ানদের ঢুকতে দিচ্ছে। চেক সরকার ইউক্রেনিয়ান রিফিউজিদের নিখরচায় এক বছরের স্বাস্থ্য বীমা,জব কার্ড এর ব্যবস্থা করেছে। তাদের কোনো যানবাহনে টিকেট লাগবে না। অর্থাৎ যতটা পারে সাহায্য কিন্তু সবাই করছে। কিন্তু সেটা কতদিন? এখনি প্রাগের রাস্তায় ভিখারীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। কোভিডের জন্য এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে, এরপর এই প্রচুর পরিমাণে রিফিউজির চাপ নিতে এই দেশগুলোর অর্থনীতি কি দাঁড়াবে বলা মুশকিল।
আপাতত প্রতিদিন যে নানারকম ভয়ের খবর পাচ্ছি, সেটা ভুলে যাচ্ছি সাধারন মানুষের নিঃস্বার্থ ঝাঁপিয়ে পড়া দেখে। তবে এই সব ছেলেমেয়ে যাদের পড়া মাঝপথে থেমে গেলো তাদের কী হবে, যুদ্ধটাই বা কতদূর বিস্তার হবে এইসব মনে করে এদেশে কেউ শান্তি তে নেই। রুটি মাংস কেনার বদলে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট কেনার প্ল্যান করতে হলে কেউ কি ভালো থাকতে পারেন?
যুদ্ধ থেমে যাক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। যার যা কিছু কথা সব আলোচনায় হওয়া সম্ভব এটা নেতারা বুঝুন। তাঁরা একটু ধৈর্য্য দেখান। শান্তি আসুক।

নেতারা কোনদিন ভাববেন না। সাধারণে তাদের বদলানোর কথা ভাবতে পারেন। শান্ত হোক।
কী ভাষায় এই লেখার প্রশংসা করবো জানি না। সমৃদ্ধ, ও আপ্লুত হলাম। কত তথ্য। কী সুন্দর বর্ণনা। ছবির মতো দেখতে পেলাম সব। আমি আমার wall এ share করার চেষ্টা করছি চান্দ্রেয়ী। এটা অনেক অনেক বেশি মানুষের পড়া দরকার।
বড়ো ভালো লেখা। ভীষণ প্রাসঙ্গিক। যুদ্ধের মধ্যেও আশার কথা হল পাশে দাঁড়ানো। সরকার, মানুষ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ভরসা যোগায় এসব চরম হতাশার মধ্যেও।
খুব সুন্দর। Informative।
Eto boro ashantir moddhyeo ei je sohomormitar choway monta bhore uthlo ek anabil anonde, er jonno asonkhyo dhonnyobad….🥰
খুব ভাল লিখেছেন, এত দূরে বসে আসল চিত্র নজরে আসছে কই! আপনার লেখায় অনেকটা স্পষ্ট হল।
অনেক কিছু নতুন জানলাম আপনার লেখা পড়ে । সত্যিই যা ক্লাসে ইতিহাসে পড়িনি । তবে ভালো লাগলো মানবিকতার দিকগুলো জানতে পেরে । রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে দুর্গতি তো সাধারণ মানুষেরই বাড়ে । যুদ্ধ নয় , সকলেই শান্তির প্রার্থনা করি । আরো খবর আপনার থেকে পেতে আগ্রহী । 🙏🏻❤️
সমৃদ্ধ হলাম। এই মিডিয়া রিপোর্টং ত কোনো জানলা সেভাবে খুলে দেয় না। সংবেদনশীল ব্যক্তিঅভিজ্ঞতার কোনো জুড়ি নেই
অনেক ধন্যবাদ
Faye D’Souza র page -এ দৈনন্দিন যুদ্ধের খবরের হেডলাইন দেখি শুধু। নিউজ চ্যানেল তো নৈব নৈব চঃ। কিন্তু ইতিহাস সমৃদ্ধ মনের এই সরাসরি অভিজ্ঞতার মরমী লেখায় একটা অন্যদিক দেখলাম। বিশ্রী, অসভ্য যুদ্ধবাজদের তান্ডব ছাপিয়ে সামনে এলো মানুষের জন্য মানুষের বিস্তৃত মনের, ঘরের তথা দেশের বাড়িয়ে দেওয়া পরিসর; পৃথিবীর সমস্ত জমির থেকেও কয়েকশো গুন বড় পরিসর। আর সেটাই আশার, আনন্দের। যাই হোক না কেন মানুষ মানবতা ভুলবে না। ভুলবে না ভালোবাসতে…! আর সেইটাই লেখাটির উপপাদ্য ও কৌলিন্য।
ভীষন সুন্দর লেখা…
💖💖👌🏻👌🏻
এই সময় এই রকম লেখা নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ খুলে দিল। বড় ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
বড়ো ভালো ও প্রয়োজনীয় লেখা. আমরা যখন নিজেদের নিয়ে মে তে আছি তখন ওই রকম যুদ্ধ পরিস্থিতি তে মানুষ যে ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে এটাই শেখা র. আপনার কাছে আরো জানতে চাই, এই নিয়ে আরো লিখুন .
প্রার্থনা করব শান্তি ফিরে আসুক , যুদ্ধ বন্ধ হোক. আর মানুষ যেনো মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ায়.
খুব প্রাসঙ্গিক লেখা। হানাহানি থেমে সবকিছু শান্ত হোক।