তিন ভাগের এক ভাগ পর্ব – চতুর্থ (শেষ পর্ব)

তিন ভাগের এক ভাগ
শ্যামলী আচার্য
“ভেড়ি দিয়ে আর কী হবে দিদি। আমার ছেলেটাই তো আর এই মাছের ব্যবসায়ে আসতি চায় নে”।
“যাই বলেন, এইসব জলের জায়গায় বড্ড সাপখোপ। সাপে কাটলে সেই কদ্দূরে যেতি হবে… হাসপাতাল কি একেনে? চারদিকে পোকামাকড়ের বাস। বাবুরা মোদের বললেন, জলটল বুজিয়ে দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিলেই…”
“মুই এবার ভেড়ি বেচে দুব দিদি, সেই ট্যাকায় মোবাইলের দুকান দিব একখান, ভালো চলবে…”
“আপনেরা তো শহরে থাকেন, মোদের কষ্টটা বোজবেন না, এইভাবে থাকা যায় নাকি?”
“যাই বলেন গো দিদি, দোকানবাজার না থাকলি চলে? এইটুকুন পুকুর তাই বেচেই দিলাম। ঝা কটা পয়সা পেলেম, ঘরের বাইরে একটা মুদি দোকান দিসি এখন…”
“বড্ড পচা পাঁকের বাস গো দিদি, জলকাদা ভেঙে মাছের চাষ আর করতে চায় না ছেলেপিলেরা। রেখে করবটা কি বলেন দিনি।”
আশেপাশে রিসর্ট, ফ্ল্যাট, হাউজিং। দখল হয়ে যাচ্ছে জলাজমি। নিঃশব্দে। রাজনীতি লুঠের ভাগ পায়। যাদের পিতৃপুরুষ চাষবাসে ব্যস্ত ছিল, তারা প্রোমোটারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কেউ এখন রাজমিস্তিরি, কেউ নতুন আবাসনের সিকিউরিটি গার্ড। কেউ সিধে পাড়ি দিয়েছে অন্য প্রদেশে। পেশা বদলে যায়। চাহিদাও।
“চায়ের দোকান দিসি গো দিদি। লাভ বেশি। খাটনি কম। ছেল্যাটা চাষের কাজে যেতিই চায় না”।
জলাভূমি ধুঁকছে। ঘুলিয়ে উঠছে পচা পাঁক।
“ও দিদি, আপনেরা শউরে মানুষ, বোজবেন না। মাছ পুষে আড়তে যেয়ে তারে বেচে আসার ধকল নিতে চায় না কেউ”।
পূর্বা তাকিয়ে দেখে অনুপমের দেড় দশকের যুদ্ধ একটু একটু করে ওই পচা পাঁকের গভীরে ডুবে যাচ্ছে।
“জলা তো চারদিকে অনেক। কম নাকি? মুই তো এই এট্টুখানি বোজাইসি…”
পুরনো কিছু মানুষজন হা-হুতাশ করেন। তাঁরা নগণ্য। দলছুট, সংখ্যালঘু। তাঁদের পায়ের গোছে লেগে থাকা শুকনো কাদা আজকের ছুটে চলা নগরসভ্যতায় বেমানান।
কলকাতা পুরসভাতে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল পূর্বা। অল্প বৃষ্টিতেই শহরের নিকাশি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত যাতে না হয়, তার প্ল্যান। জলাভূমি বাঁচিয়ে রাখার বিস্তারিত প্রয়োজনীয়তা। বায়োডাইভার্সিটি বোর্ড, পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড, পরিবেশ দপ্তর, কর্পোরেশন, রাজ্য, কেন্দ্র হয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছতে লাগল রিপোর্ট। রিপোর্ট ছোট থেকে বড় হল ক্রমশ। জুড়ে গেল ম্যাপ, ডেটা, তুলনামূলক পর্যালোচনা, পরিবেশ, মানুষ, জীব, জড়।
নিস্তরঙ্গ জলে ঢিল পড়ে। গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে জলের বৃত্ত হয়। সময়ে সব স্থির। শান্ত।
অনুপম সেনের পাগলামি নিয়ে ইতিমধ্যেই সবাই ওয়াকিবহাল। পাগলামি ছাড়া কী? চারপাশে সবকিছুর এত উন্নয়ন, এত উন্নতি, এত টেকনোলজির রমরমা, তার মধ্যে সেই কোন আদ্যিকালের প্রাকৃতিক থিওরি কে শুনতে চায়? ন্যাচরাল নর্মাল কথাগুলোই এখন আনন্যাচরাল। অ্যাবনর্মাল। তাঁর ল্যাবের রিপোর্ট উপচে পড়ে বিভিন্ন দফতরের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে।
ওয়েটল্যান্ডের দিগন্তছোঁয়া জলে কমলা রঙের সূর্য রোজ টুপ করে ডুবে যায়।
অনুপমের ল্যাবে বসে তাঁর ডায়েরির পাতা উলটে দেখে পূর্বা।
পৃথিবীর তিন ভাগ জল। এক ভাগ স্থল। আর সেই স্থলভূমির অধিপতি কিছু দাম্ভিক মানুষ। সর্বনিয়ন্তা। তাদের দাপটে জল বাড়বে। কেউ জানে না, জল বাড়ছে। আকাশের চাদর ফুটো হচ্ছে, পৃথিবী তেতে উঠছে, মেরুপ্রদেশের বরফ গলছে। আর জল বাড়ছে। সব ভেসে যাবে একদিন। এই সভ্যতা, এই নগর বন্দর, মানুষ। সব ডুবে যাবে। তার আগে জোট বাঁধতে হবে আমাদের। যারা মাটির কাছাকাছি আছে, যারা জলের পাশে আছে, যারা জঙ্গলের কিনারায় আছে, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আগে তারা বাঁচবে, তারপর তো বাকি পৃথিবী। তাদের কাছে যাওয়া আগে দরকার। বোঝানো দরকার তাদের। ভীষণ জরুরি।
রিপোর্টে অনেক কথা লিখেছিল পূর্বা। টানা সাড়ে আট মাস ধরে ঘুরে দেখে খুঁজে যখন সব লেখে তখন আর অনুপম দেখতে পাননি পূর্বার সেই বিরাট সার্ভে রিপোর্ট। আরও অনেক বড় কাজে হয়ত তখন তাঁর ডাক পড়েছিল। কিন্তু কাজ চলতে চলতেই বুঝতে পারেন তাঁর স্বপ্নের সেই অঞ্চল বদলে দিচ্ছে তাঁর পৃথিবীর অবিবেচক মানুষ। তাদের জন্য টোপ ফেলছে কর্পোরেট দুনিয়া। তাদের একটু একটু করে গিলে খাচ্ছে নাগরিক সভ্যতার লোভ।
পূর্বা তার রিপোর্ট পাঠিয়েছে আন্তর্জাতিক সীমানায়। স্যার যেমন বলে দিয়েছিলেন। অনুপম সেনের ল্যাবে বসে সে ঝড়ের গতিতে লিখে চলে। থামলে চলবে না। হার মানবে কেন? কার কাছে? ল্যাবের বাইরে বিরাট বড় কাচের জানলার ওপর ঝুঁকে পড়েছে আমগাছের ডাল। নতুন মঞ্জরীতে ঢেকে গেছে সবুজ পাতা। কাঠবেড়ালীটার ব্যস্ততা বেড়েছে। পূর্বা লিখতে লিখতে একবার তাকায় তার দিকে। ক্ষুদ্র, তবু তুচ্ছ নই। প্রেস কনফারেন্সে ওই কাঠবেড়ালীটার কথা বলেই শুরু করলে হয় না?
শ্যামলী আচার্য