তিন ভাগের একভাগ পর্ব – দুই
শ্যামলী আচার্য
ময়লা-জলের মধ্যে রয়েছে নানারকম ব্যাকটিরিয়া আর জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে মাছ, জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ আর শ্যাওলা। এদের মধ্যে ডেট্রিভোর প্রচুর। যারা শুধুই ময়লা আবর্জনা খায়। সূর্যের আলো পেলে গাছের সবুজ পাতা অক্সিজেন দেয়, এ তো সেই শিশুপাঠ্য কাহিনি। সবাই পড়ে, সবাইকে পড়ানো হয়। যথারীতি সকলে ভুলেও যায়। ঠিক তেমনই এই জলাশয়ের ইকো-সিস্টেম। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে। একটা আশ্চর্য বোঝাপড়া রয়েছে এই দুই দলের মধ্যে। দুজনের খাবার, দু’পক্ষের থাকার জায়গা, দু’দলের মিলেমিশে বেঁধে বেঁধে থাকার ক্ষমতার তুলনা হয় না। স্বার্থপরতার কোনও জায়গাই নেই। আসলে উন্নত মস্তিষ্ক মানেই তো জটিল প্যাঁচ। আর এদের হল সরলতম আদিম জীবন। সবটাই প্রকাশ্যে দেওয়া নেওয়া। লুকোছাপা নেই। প্রত্যেকে অন্যের জন্য হাত বাড়িয়েই রেখেছে। না হলে যে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন।
এত সরল হিসেব যদি জটিল মানুষের মাথায় ঢুকত!
পূর্বা ভাবছিল, মানুষ কেন এমন পারে না! শুধু নিজেদের মধ্যে দলাদলি রেষারেষি। সারাদিন ধরে নিজেরা নিজেদের আঁচড়াচ্ছে, কামড়াচ্ছে, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পরিবেশকেও একতিল ছাড়ছে না। জল-মাটি-আকাশ সর্বত্র তাদের মারাত্মক দাপট। একের পর এক গাছপালা কেটে, নির্বিচারে চারধারে সব পুকুর আর জলাজমি বুজিয়ে… কী এক আক্রোশ যেন। অবিশ্বাস্য দখলদারি। জলাজমিতে, নিকাশি নালায় যতদূর চোখ যায় শুধু গুচ্ছের প্লাস্টিক আর থার্মোকল। ময়লানিকাশি ব্যবস্থায় কী ভয়ংকর এক দূষণ। গা গুলিয়ে উঠছে দেখে। প্রযুক্তির অভিশাপ। এর ফল যে কী দাঁড়াবে, ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। কী পড়ে থাকবে পরের প্রজন্মের জন্য?
“এখানে এখন রাস্তা বিরাট চওড়া হবে দিদি। নতুন টাউনশিপ হবে। খুব বড় কোম্পানি প্রোমোট করছে। প্রচুর টাকা ঢালছে। দেখুন না, কেমন করে নালা ভরাট করছে”।
অনুপমবাবুর কথামতো জয়ন্ত দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে পূর্বা। জয়ন্ত এই অঞ্চলের লোক। এখানেই বড় হয়েছে। চারপাশটা সে দ্রুত বদলে যেতে দেখেছে। সে উন্নয়নে বিশ্বাসী, কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস করে নয়। বরং সে বেশ সংবেদনশীল। তাই প্রতিবার এখানে কাজ করতে আসার সময় জয়ন্তকেই যোগাযোগ করেন অনুপম।
পূর্বা ঠিক করেছে, স্যারের প্ল্যানমাফিক সবটা সরেজমিনে দেখতে হবে। রাস্তা চওড়া হওয়ার পরিকল্পনা আর নতুন কথা কি। পাড়ার পুকুর, ছোট ডোবা সব একের পর এক বুজিয়ে দিব্যি বাড়িঘর হয়ে গেল। ছোট বাড়ি ভেঙে বড় ফ্ল্যাট। গ্রাম আর মফঃস্বল ছেড়ে সকলে এখন শহরমুখী। আর শহর বাড়বে না? মানুষগুলো তবে থাকবে কোথায়? পূর্বা হাসতে থাকে। অসহায় হাসি। মানুষ যত বেশি পড়ে, তত কম জানে। জানতে জানতেই কি সে এখন জানোয়ারের অধম?
“একদিকে এইসব জলাটলা বুজিয়ে ভালোই হয়েছে দিদি। এখানকার মানুষ এখন চট করে বড়লোক হতে চাইছে। সবাই দামি মোবাইল কিনবে, ঘরে ডিশ অ্যান্টেনা দেওয়া টিভি নেবে, ভ্যানরিকশার বদলে বাইক কিনবে, টোটো কিনবে…”
পূর্ব কলকাতা জলাভূমির এই বিরাট অঞ্চলের মানুষগুলো প্রায় আশি-একশো বছর ধরে যা জানে, তার নাম পরিবেশ। তাকে বলে বাস্তুতন্ত্র। তার সঙ্গে পড়ার বইয়ের জ্ঞানের সম্পর্ক কোথায়? অথচ তারাই তো প্রাণপণে চারপাশ রক্ষা করে চলেছে এতকাল। তারাই এখন নিজেদের অস্তিত্ব বেচে দিতে চায়? জেনে, না একেবারে না জেনে?
“এখানে গত কয়েক বছরে অনেকগুলো ভেড়ি পট পট করে এক্কেবারে বন্ধ হয়ে গেছে দিদি”।
“তাহলে যাদের ভেড়ি ছিল, তাদের এখন কি অবস্থা?”
“চলুন দিদি। আপনাকে ওদের কাছেই নিয়ে যাচ্ছি। স্যার আমাকে সবকিছু বলে রেখেছেন।”
জয়ন্তর সঙ্গে পূর্বা ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে যায়। নোট নেয় মাথার মধ্যে। বাড়ি ফিরেই কাগজে লিখবে। রিপোর্ট তৈরি করতে হবে তাকে। রামসার সাইটের জল্ভূমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে রোজ। প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচানো শুধু নয়, অসংখ্য মানুষকে বাঁচানো।
“দিদি, আপনি একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি শুধু যতটুকু জিগ্যেস করবেন ওরা কিন্তু ততটুকুই বলবে। প্লিজ একটু বুঝেশুনে…”
পূর্বাও জানে, লোভ আর দূষণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পরিবেশ যেমন বদলে যাচ্ছে। মানুষও। অতি দ্রুত গতি। পতনশীল যে কোনও বস্তুর গতি যেমন হয়।
চৌবাগার রবি, মুকুন্দপুরের শংকর, করিমপুরের সাদিক, বৈচতলার সুজন, খোদাটির রাজু, ধলেন্দার বাবলু…। সকলকে জড়ো করা হয়েছে। আরও অনেকে। কেউ বলবে, কেউ বলবে না। একদিন নয়, প্রতিদিন। অনেকদিন। পূর্বার রোজকার কাজ। খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ। জলের স্যাম্পল, রাস্তার মাপ, মানুষের কথা। কোনওদিন সঙ্গে থাকবে জয়ন্ত। কোনওদিন হয়ত অন্য কেউ।
পূর্বা হাতের নোটবুকে একবার চট করে চোখ বুলিয়ে নেয়। অনুপমের ম্যাপ অনুযায়ী বারো হাজার পাঁচশো হেক্টর অঞ্চলের মধ্যে ছিল বত্রিশটি মৌজা আর দুটো মিউনিসিপ্যালিটি। কিন্তু এখন যেন হিসেবের গরমিল হচ্ছে।
চৌবাগার কাছেই বাস থেকে নেমে পড়ে পূর্বা। জয়ন্তর আজও বাসস্টপেই থাকার কথা। জয়ন্ত এই অঞ্চলের বাসিন্দা। অনুপমবাবুর খুব বিশ্বস্ত সহচর।
রোদের মধ্যেও একগাল হাসিমুখ। জয়ন্ত এইরকমই।
“ভ্যানরিকশা এনেছি দিদি। আপনি সাইকেলে পারবেন না”।
পূর্বা হেসে ফেলে জয়ন্তর কথায়।
“ভালোই করেছ। আমি তোমার স্যারের মতো মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারি। কিন্তু সাইকেল চালিয়ে এতদূর যেতে পারব না”।
ভ্যানচালকটির খালি গা। মাথায় গামছা জড়ানো। সে’ও বেশ হাসিখুশি। ভ্যানের চালকটির নাম পঞ্চু।
“দিদি, আপনে শ্যাষম্যাষ এই পচা খালের ছবি তোলবেন, শোনলাম”।
পূর্বা বলে, “তোমার ছবিও তুলব। চলো দেখি এবার”।
“ছবি তো কত উটল, কাগজে কত কতা ছাপাও হয় শুনি… আপনে কি কাগজে কাজ করেন? নয়া টিবির খবর?”
পূর্বা হাসে। “তা বলতে পারো। কাগজেই লিখব। ঘুরে দেখি আগে”।
“লিকেপড়ে কিচু হয় না দিদি। সব পচা পাঁক। শুদু জলে নয়, ড্যাঙ্গাতেও পাঁক। পাঁক আর পাপ।”
“আচ্ছা পঞ্চু, টিভিতে দেখালে কাজ হবে কিছু?”
“কাজ? অ দিদি, কাজের কাজ তো কেউ করে না গো… ছবিছাবা তোলে। যা হওয়ার তাই হয়।”
ভ্যানচালকটির চাকা ঘোরে। সে কথা বলে চলে অনর্গল। কিছু শব্দ সাজানো পরপর। সভ্য মানুষের কাছে যার কোনও মানে নেই। বিজ্ঞানীর কাছে হয়ত অর্থ রয়েছে। যে পরিবেশ বাঁচাতে চায়, সে শোনে। পরিবেশের মতোই চুপ করে শোনে।
জয়ন্ত আর পূর্বা বসে থাকে ভ্যানের পিছনে পা ঝুলিয়ে।
শ্যামলী আচার্য