তিন ভাগের এক ভাগ পর্ব – তিন

তিন ভাগের এক ভাগ পর্ব – তিন

তিন ভাগের এক ভাগ

শ্যামলী আচার্য

 

“প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের জীবিকা কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে। প্রথমে তোমাকে যেতে হবে সরাসরি তাদের কাছে। কিন্তু তারা যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়, কেন কীজন্য ওদের কাছে এসেছ তুমি। মনে রাখবে আমাদের তথ্য চাই। বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য। যে তথ্য দিয়ে আমরা…” ফেরার সময় বাসে বসে বসে স্যারের কথাগুলোই ভাবছিল পূর্বা। 

 

পূর্বার স্যার। ডঃ অনুপম সেন। একসময় ছিলেন কলকাতার প্ল্যানিং বোর্ডে ইঞ্জিনিয়ার-আধিকারিক সদস্য। আটের দশকের শুরু থেকেই যার কাজকর্ম অন্য খাতে বইছে। সেসব গল্প স্যারের নিজের মুখেই শোনা। 

প্ল্যানিং বোর্ডের মিটিঙে রাশভারি অর্থমন্ত্রী জানতে চাইছেন, “শহরের এই এত ময়লা জল কি আদৌ আবার কোনও কাজে ব্যবহার করা যায়? জাস্ট কাজে লাগানোর কথা বলছি আর কি। আপনারা একটু ভেবে দেখুন না, ধরুন যদি সেই জল ব্যবহার না করা যায়, তাহলে এই বর্জ্য সরানোর ব্যবস্থা কী হবে? প্রত্যেকের বাথরুম থেকে প্রতি মুহূর্তে নোংরা জল বেরিয়ে সেগুলো যাচ্ছে কোথায়? এই নালাগুলোর সঙ্গে কোন কোন নদী জুড়ে আছে? কেউ কিছু ডিটেলসে বলতে পারবেন?”

একের পর এক প্রশ্নে সকলেই উত্তর হাতড়াচ্ছেন। শহরের নিকাশি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত প্রযুক্তিবিদরা নানারকম পুরনো আদ্যিকালের ম্যাপ নিয়ে তৈরি। পুরো নিকাশি ব্যবস্থা তাঁরা ছবি দেখিয়ে বুঝিয়ে দেবেন। কিন্তু ওই নিকাশি জলের ভবিষ্যৎ তো তাঁদের জানা নেই। বাস্তুতন্ত্র শব্দটি তো দূরস্থান, পরিবেশ বলতে তখন আলাদা করে কেউ পরিচ্ছন্নতার কথাও ভাবতেন না।    

“আচ্ছা মিঃ অনুপম সেন, আমাদের আপনি এই কাজটায় কীভাবে সাহায্য করতে পারেন?” 

অনুপম চমকে তাকান মন্ত্রীর দিকে। সুশিক্ষিত, মার্জিত এই অর্থমন্ত্রী জানেন কাকে দিয়ে কোন কাজ করানো সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে সদ্য ক্ষমতায় এসে দু’তিন বছরের মধ্যেই বিভিন্ন দিকে নজর দিতে শুরু করেছে সরকার। আর সেই সরকারের প্রতিনিধিস্থানীয় প্রতিটি মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে এই অর্থমন্ত্রী ভদ্রলোকের ওপর অত্যন্ত আস্থা অনুপমের। তিনি খুব ভালো করে জানেন, এই প্ল্যানিং বোর্ড তাঁর কাছে ঠিক কী চাইছে।   

“মিঃ সেন, আমি একটা ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট চাইছি। যত দ্রুত সম্ভব। আমি শিওর, আপনিই পারবেন।” 

অনুপম অর্থমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে এই প্রশ্ন করতে পারেন না, এত লোক থাকতে আমাকে কেন? তার কারণ, অনুপম নিজেও খুব ভালো করেই এর উত্তরটা জানেন।   

“আপনি ঠিক সাতদিনের মাথায় আমাকে কতগুলো বেসিক প্রশ্নের উত্তর লিখে দেবেন। আমি আপনাকে মোটামুটি কিছু জিজ্ঞাস্য পাঠিয়ে রাখছি”। 

বাকিদের উৎসুক চোখের সামনে দিয়েই মন্ত্রী বেরিয়ে গেলেন। অনুপমের পাশেই পূর্ত দফতরের রঞ্জিত শাসমল। 

“এ আবার কি উটকো যন্ত্রণায় পড়া গেল! অ্যাদ্দিন ধরে নালানর্দমা দিয়ে জল যাচ্ছিল যদ্দুর দেখতে পাচ্ছি সেই বিদ্যাধরী নদীতে। সেই নদীর অবস্থা তো আর এখন তেমন সুবিধের নয়। কিন্তু ওই ময়লা জল নিয়ে আবার ফের কী করতে চাইছেন এঁরা?”  

অনুপম ঘুরে বসেন। 

“আচ্ছা রঞ্জিতদা, এই নিকাশি ব্যবস্থা তো সেই ব্রিটিশ আমলের”। 

“হ্যাঁ ভায়া, যদ্দূর জানি, সেই চারের দশকের”।

“সেই সময়কার কলকাতা কর্পোরেশনের কোনও প্ল্যান বা ম্যাপ পাওয়া যাবে না?”

“খুব মুশকিল। তুমি দপ্তরে ফাইলপত্র একবার উলটে দেখতে পারো। তবে অত পুরনো কাগজ পাওয়া খুব মুশকিল, ব্রিটিশ আমলের সব কাগজই প্রায় লোপাট। যা যতটুকু আছে, সব সেই কোন স্তূপের তলায় চাপা পড়ে আছে… খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার হাল হবে”।   

অনুপম চুপ করে যান। ইকোলজি শব্দটা এখনও এইদেশে অত্যন্ত অপরিচিত। আর অতি সম্প্রতি এই ইকোলজি নিয়ে গবেষণা করে একটি ডক্টরেট উপাধি পেয়েছেন তিনি। হয়ত সেই কারণেই এই প্ল্যানিং রিপোর্টের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়তে তিনি রাজি নন।      

পূর্বাকে অনুপম বিস্তারিত বুঝিয়ে দিয়েছেন। এক সময় সরকারি আধিকারিক হিসেবে কাজের তাগিদে আর পরিবেশ বাঁচানোর নেশায় তন্ন তন্ন করে ইতিহাস ঘেঁটেছেন তিনি। সেই ইতিহাস ছিল চমকে ওঠার মতো।   

 একের পর এক ডকুমেন্টেড রেফারেন্স পাওয়া যায়, পাল-সেনযুগ থেকে, পাঠান যুগ, বারো ভুঁইয়া হয়ে এবং মুঘল যুগের মধ্যে বিদ্যাধরী নদী দিয়ে পর্তুগীজদের আসা — এ অঞ্চল কলকাতার থেকে অনেক বেশি কুলীন। বৃটিশরা যখন বুঝলেন, হুগলী নদীতে আর ময়লা ফেলা ঠিক হচ্ছে না, তখন এইরকম একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের স্বাভাবিক ভৌগোলিক অবস্থান ও ঢালকে কাজে লাগিয়ে পর পর দুটো খাল কাটলেন। সারা বছরের জন্য একটি, বর্ষার বাড়তি জলের জন্য আরেকটি। খানিক দূর গিয়ে, ঐ খালদুটো আবার মিশেছে। বিদ্যাধরী নদী বইছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। কাজেই উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়া খাল, পূর্ব থেকে পশ্চিমে বওয়া বিদ্যাধরী নদীর ধারাকে আড়াআড়িভাবে কাটল। দিনের পর দিন, কলকাতার ময়লা জল বইতে বইতে, খাঁড়ির নোনা জলের চরিত্রই একটু একটু করে বদলে গেল। 

প্ল্যানিং বোর্ডে কর্মরত সদস্য অনুপম। তখন তাঁর একার কাঁধে এই কাজের গুরুদায়িত্ব। সরেজমিনে তিনি এবার দেখে নিতে চাইলেন এই বিস্তৃত অঞ্চলটি। কেন বৃটিশরা করলেন এইরকম প্ল্যান?  

ঠাট্টা করে বলতেন, “নিজের চোখে দেখতে চেয়েছিলাম, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়”।     

পূর্বা নিজের কাজের সূত্রেই জানে, কলকাতার উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এসেছে অসংখ্য ছোট ছোট নিকাশি নালা আর পুরনো খাল। শহরের সমস্ত বর্জ্য নোংরা জল এখনকার সায়েন্স সিটির পূর্বদিকে বাসন্তী-ঘটকপুকুরের দিকের নোংরা জলের খাল দিয়েই বেরিয়ে যায়।   

অনুপম নিজে বলেছেন, তিরিশের দশক থেকে ধাপার আশপাশে লিজ মারফত যেমন সবজি চাষ শুরু হয়েছিল তেমনি ধাপা, মানপুর, হাটগাছা, ধর্মতলা, বৈচতলা, চৌবাগা, পশ্চিম চৌবাগা, ধলেন্দা, মুকুন্দপুর, নয়াবাদ জুড়ে তেমনি মাছ চাষও শুরু হয়। 

“আপনি এত ডিটেলে জানলেন কেমন করে স্যার? কোনও লিখিত রিপোর্ট বা তথ্য ছিল কী?”

পূর্বার প্রশ্নে অনুপম একটু হাসেন।  

“নাঃ। ছিল না কিচ্ছু। থাকার কথাও নয়। সব কথা ফাইলে বা নোটশিটে থাকে না”। 

“তাহলে?” 

অনুপমের ঘরের কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যায় একটা বিশাল আমগাছ। তার ডালে একা ব্যস্ত হয়ে লাফিয়ে বেড়ানো একটা কাঠবেড়ালী, তার দিকে একবার মায়াভরা চোখে তাকান অনুপম।

“আমার চিরকাল বড্ড জেদ। মন্ত্রীমশাই কাজ দিয়েছেন বলে নয়, বা নিজে পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসি বলে নয়, আমাকে কেমন যেন টেনেছিল ওই জায়গাটা। জানো পূর্বা, আমি একদিন ভোরবেলা উঠে ওই ধাপা অঞ্চলের খালগুলো বরাবর একা একা হাঁটতে শুরু করেছিলাম”। 

“মানে! পায়ে হেঁটে?” আঁতকে ওঠে পূর্বা।  

“হ্যাঁ পূর্বা। হাঁটা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। তখন ওখানে যাওয়া আসার তেমন রাস্তাই বা কোথায়?” অনুপম একবার থামেন। “দেখো পূর্বা, আমরা কিন্তু কেউ জানি না, ঠিক কে কবে কীভাবে আগুন আবিষ্কার করেছিল। সংঘবদ্ধ মানুষ, সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর চেষ্টা। তাদের মধ্যেই কেউ না কেউ একদিন হঠাৎ দুটো পাথর ঠুকে আগুনের ফুলকি দেখেছিল, তাই না? অথচ তার নাম জানি না। শুধু উপকারিতাটুকু ভোগ করে চলেছি।”    

পূর্বা অবাক হয়ে বলে, “স্যার, আপনার কাজের মধ্যেই দেখেছি, চারের দশকের আগে থেকেই বিদ্যাধরী নদী ক্রমশ শুকিয়ে যেতে শুরু করে। তাহলে সেই সময় থেকেই কি এই জলাভূমি…”  

“খানিকটা ঠিক ধরেছ। আসলে যখন বিদ্যাধরী নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, সেই সময় ওই নদীর কাছাকাছি থাকা মানুষগুলো কী করবে? নদী শুকিয়ে গেলে খাবে কী? তারা এতদিন নদীকেন্দ্রিক জীবিকায় অভ্যস্ত ছিল। তাই, এখানকার অসংখ্য চাষী, মাছের কারবারীরা সবাই বসে তখন এক আশ্চর্য পরিকল্পনা করেন। সেই চারের দশকের কলকাতা কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়াররা তাদের এই প্ল্যান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাঁরা কিন্তু সমর্থন করেছেন এই দেশজ প্ল্যান। অথচ তার পরে একটু একটু করে এদের কথা, এই জায়গাটার কথা, এখানকার ইকো-সিস্টেমের ইউনিকনেসের কথা সব্বাই বেমালুম ভুলে গেল। আমরা কেউ ওই ঘটনাগুলোর বিজ্ঞানসম্মত কারণ নিয়ে তলিয়ে ভাবলাম না।”

পূর্বা দেখতে পায় অনুপমের চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে।  

“আমি হাঁটতে হাঁটতে দেখেছি খালের আশেপাশে অসংখ্য জলাশয়। তুমিও লক্ষ্য করে দেখবে কোথাও সরু নালা কাটা হয়েছে, কোথাও পাইপ দিয়ে আবার কোথাও পাম্প করে ওখানকার সাধারণ মানুষ ময়লা জল ঢুকিয়ে দিচ্ছে ওই জলাশয়ের মধ্যে। ওই জলাশয়ে নোংরা জল ধরে রাখছে তারা। কিন্তু অতিরিক্ত নয়। খানিকটা নোংরা জল ঢুকছে। বাকিটা পরিষ্কার। মনে রেখো, আমাদের দেশে ক্রান্তীয় জলবায়ু। কাজেই ভরপুর রোদ পাচ্ছি সারাদিন। অতএব ওই ময়লা জল পরিশোধন হচ্ছে ওই জলাশয়ের মধ্যেই। একদম প্রাকৃতিক উপায়ে। এটা পুরোপুরি দেশজ জ্ঞান, এবং সেটা চর্চিত হয়েছে দিনের পর দিন কমিউনিটি প্র্যাক্টিসের মধ্য দিয়ে।  নোংরা জল ভেড়িতে ঢোকে, তার  মধ্যেকার ময়লা উপাদানগুলো থিতিয়ে পড়ে। ওই থিতিয়ে পড়া ময়লাগুলো হল মাছেদের খাবার।  এছাড়া বেশ কয়েকরকম ডেট্রিভোরাস কনজিউমার তো আছেই। তিন থেকে সাতদিন পরে এই ভেড়ি থেকেই পরিষ্কার জল বেরিয়ে যায়। এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে, এই জল কুলটি গাঙ-এ পড়ে, মানে ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমের মধ্যে ঢোকে। ওখানে ময়লা জল পরিশোধন করার জন্য একটা মডার্ন ডিস্টিলেশন প্লান্ট বসাতে গেলে সরকারের কয়েক কোটি টাকা খরচ হত। অথচ ওই প্লান্ট থেকে সেরা মানের পুরোপুরি পরিশুদ্ধ জল পাওয়াই যেত না। তার মানে, একবার ভাবো পূর্বা, কোনও যন্ত্রপাতি ছাড়াই প্রকৃতি ওই জল পরিশোধনের কাজ করে চলেছে নিঃসাড়ে। ওখানকার মানুষজন ব্যাপারটা জানতেন। হয়ত তার পিছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তাদের কাছে ছিল না… কিন্তু তাদের রোজকার কাজের অভিজ্ঞতা আমাকে খুব সাহায্য করেছিল। ওটাই ছিল ওদের ফীল্ড ওয়ার্ক। তার ওপর ভিত্তি করে আমার রিপোর্টে তখন এই সমস্ত কথাই ছিল”।      

অনুপম সেদিন লড়াই করেছিলেন। হয়ত অসম লড়াই। দেড় দশক ধরে তাঁর একার লড়াই। ওই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকার রক্ষার লড়াই। যারা দীর্ঘ সময় ধরে মাছের জোগান দিচ্ছে শহরকে, সব্জির ভাণ্ডার তৈরি করছে, আবার একই সঙ্গে শহরের যাবতীয় ময়লা জলকে পরিশুদ্ধ করে তুলছে। কলকাতা শহরের কিডনি। অথচ তাদের কথা ভাবার মতো কোনও পরিকল্পনা নেই। তাদের কথা ভেবেই ‘রামসার সাইট’, ওই বিরাট জলাভূমি জায়গাটাকে সংরক্ষণ করে টিঁকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা।  

সেই বিশাল জলাভূমির চারপাশে এখন অসংখ্য শকুনের চোখ।   

শ্যামলী আচার্য

 

Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *