উত্তরণ

উত্তরণ

কল্যাণী মিত্র ঘোষ

 

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রীতি দেবী অঞ্জনা দেবীকে বললেন,
“দিদি, সুখবরটা ফোনে দেবোনা বলেই হুড়তে পুড়তে একটা ওলা নিয়ে বউবাজার থেকে চলে এলাম!”

“খুব ভালো করেছেন দিদি, তবে আমার গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। সুখবর টা কি দিদি?”
অঞ্জনা দেবী বলেন।

“ধরতে পারলেন না তো? আরে আমরা ঠাকুমা দিদিমা হচ্ছি বেয়ান। এতদিন তো রঞ্জা মা শুধুই অফিস আর ট্যুর নিয়েই ব্যস্ত ছিলো দিদি। আমরাও চাকরি করা বউ পছন্দ করেছিলাম বলে কোনো চাপ দিইনি। এখন নিজেরাই যা ভালো বুঝেছে করেছে।”

খুব খুশী হলেন অঞ্জনা দেবী। মেয়েটার মুখ থেকে শুনলে আর একটু বেশী ভালো লাগতো এই যা। কিন্তু রঞ্জার শাশুড়ি মা মানুষটা খুব ভালো, তাই তো অতদূর থেকে ছুটে এলেন।  এদিকে সবাই বলাবলি করছিল ছেলেমেয়ে আসছে না কেন, ডাক্তার দেখালেই তো পারে, আজকাল তো সবই সম্ভব! যাক, সকলের মুখের ওপর একটা জবাব দেওয়া যাবে।

অঞ্জনা দেবী একটা অসুখী দাম্পত্য থেকে বেরিয়ে এসে একা মেয়েকে মানুষ করেছেন। যেদিন এক কাপড়ে স্বামীর ঘর ছেড়েছিলেন সেদিন জানতেনই না কি ভাবে পাঁচ বছরের
মেয়েকে মানুষ করবেন। ওনার স্বামী প্রবীর বাবু সি ই এস সি র তারাতলা অফিসের কেরানী ছিলেন। অসম্ভব রাগী এবং মদ্যপ। ওনারা স্বামী স্ত্রী বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন নাকতলায়, প্রবীর বাবুর অফিসে যাতায়াতের সুবিধা হবে বলে। বিয়ের দু বছর পর থেকেই প্রবীর বাবুর মদ খাওয়া ভয়াবহ আকার ধারণ করে, সন্ধেবেলা অফিস থেকে অধঃস্তন কর্মচারীদের ডেকে এনে বাড়িতে রীতিমত ঠেক বসিয়ে ফেলতেন। পরিবারের দিকে কোনো নজর দেননি, সবটাই অঞ্জনা দেবী সামলেছেন। রঞ্জা বাবার সঙ্গ কখনোই সেভাবে পায়নি, তার শৈশবের স্মৃতি মানেই মা। রঞ্জার পাঁচ বছর বয়সে একবার অতিরিক্ত মদ খেয়ে পাড়ার ভেতরে একটা নর্দমায় পড়ে গেছিলেন প্রবীর বাবু। ক্লাবের ছেলেরা ধরাধরি করে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ওই নোংরা কাদা মাখা, প্যান্টে অসাড়ে পেচ্ছাপ করে ফেলা মানুষটার দিকে তাকাতে বমি উঠে আসছিল অঞ্জনা দেবীর। সেই রাতটা লক্ষ্য রেখেছিলেন যাতে ওনার স্বামী দেবতা পড়ে গিয়ে আর নতুন কোনো অঘটন না ঘটান। তারপর ভোরের দিকে একটা স্যুটকেসে প্রয়োজনীয় জিনিস, কাগজপত্র ইত্যাদি ভরে মেয়েকে কোলে নিয়ে সোজা দাদুর বাড়ি উপস্থিত হন। মা বাবা থাকতেন বেলুড়ে, কিন্তু তাঁদের আর উত্যক্ত করতে চাননি। দাদুর দেশের বাড়ি হাওড়ার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে, একদিকে ভালো হলো, খুব বেশী চেনা লোকের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলনা। দাদু তদানীন্তন শাসক দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন, সুনাম ছিল পার্টি অফিসে তাই অঞ্জনা দেবীর নিরাপত্তার অভাব হলনা। এর পরের বছরেই পার্টির মধ্যস্থতায় এবং নাকতলার প্রতিবেশীদের সহৃদয়তায় খুব সহজেই ডিভোর্স পেয়ে যান তিনি। তার ছ মাস পরে পাশের গ্রামের একটি স্কুলে বাংলার শিক্ষিকা হিসেবে চাকরিও পেয়ে যান। দাদুর পরোক্ষ প্রভাব অবশ্য কিছুটা সাহায্য করেছিল চাকরি টা পেতে। কিন্তু অঞ্জনা দেবী নিজ গুণে অত্যন্ত সুনাম অর্জন করেন বছর খানেকের মধ্যেই। তারপর অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিভিন্ন স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিতে দিতে একসময় কলকাতার একটি নামী গার্লস স্কুলে সহ প্রধানা শিক্ষিকার কাজ পেয়ে যান, জীবন সংগ্রামে জয়ী হন। মেয়ে রঞ্জাও অসম্ভব বিদূষী। নিজেই নিজের কেরিয়ার গড়ে নেয়, এইচ আর ম্যানেজমেন্ট কোর্স করে একটা  বহুজাতিক সংস্থার এইচ আর ম্যানেজারের কাজ পেয়ে যায়। হাজরার সুজাতা সদনের কাছাকাছি একটি অ্যাপার্টমেন্টে ছোট দুকামরার ফ্ল্যাট কিনে তারপর অবসর নেন অঞ্জনা দেবী।

মেয়ের বিয়েটা অবশ্য সম্বন্ধ করেই হয়। জামাই সিদ্ধার্থ উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ির ছেলে। যৌথ পরিবার, স্বচ্ছল কিন্তু রক্ষণশীল। অঞ্জনা দেবী ভাবলেন একদম একা একা মানুষ হওয়া মেয়েটার পক্ষে এটাই ভালো হবে। সিদ্ধার্থ ব্যাংকের, অফিসার। রঞ্জার চাকরি দারুণ ঝাঁ চকচকে। প্রায়ই প্লেনে হিল্লী দিল্লী করতে হয়, কোনোদিনও এক সপ্তাহের ট্যুর কখনো আবার কলকাতাতেই তাজ বেঙ্গলে ডিনার। তুলনায় সিদ্ধার্থের চাকরি স্থিতিশীল কিন্তু ম্যাড়মেড়ে। সিদ্ধার্থ কি হীনমন্যতায় ভোগে? বোঝা যায় না। বাড়ির সকলেই রঞ্জা কে ভীষণ ভালোবাসে। রঞ্জার সৌন্দর্য্য খুব চাপা, একবার দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো নয়, কিন্তু তারপরেই “মেয়েটার মধ্যে কি যেন একটা আছে” ভেবে ফিরে তাকাতে হয়। ওর ব্যক্তিত্ব, আলগা শ্রী এবং উচ্চমানের কর্মজীবন ওকে ভীড়ের মধ্যে আলাদা করে চেনায়। ওর পাতলা ঠোঁট আর ভাসা ভাসা দুটি চোখ অনেক পুরুষের হৃদয়ে দোলা দেয়। সিদ্ধার্থ প্রথম দর্শনেই ওর প্রেমে পড়ে যায়।

রঞ্জা শ্বশুর বাড়ির জন্য দু হাতে খরচ করে। বাড়ির টুকটাক কাজেও যথেষ্ট সাহায্য করে। যেমন রবিবার হলেই গাছকোমর বেঁধে সকলের জন্য পাঁঠার মাংস রান্না করতে বসে যায়। বিকেলে সকলকে চা করে দেয়। জ্যাঠশ্বশুর গাড়ি বারান্দায় বসে থাকেন, তখন সে ওনাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনায়। এগুলো করে সে নারীর চিরন্তন এক অপরাধবোধ থেকে, ঘরে আর বাইরে সমান ভাবে যাতে সে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে পারে, কোথাও যেন কোনো ত্রুটি না থাকে, কেউ যেন তার বদনাম না করে। সুনাম কেনার থেকেও বদনামের বোঝা বয়ে বেড়ানোটাই বেশী ভাবায় রঞ্জা কে।

বিয়ের মাস ছয়েক পর থেকেই সিদ্ধার্থ সন্তান আনার কথা বলতে থাকে। রঞ্জার চূড়ান্ত ব্যস্ত কর্মজীবন সেটা হতে দেয় না। রঞ্জা নিয়মিত গর্ভ নিরোধক বড়ি খেয়ে নিজেকে একটু সময় দেয়। সে যেহেতু একটা কঠিন শৈশব দেখেছে, পরবর্তীকালেও অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে তাই চট করে কাউকে বিশ্বাস করতে পারেনা। ও ভাবে এমনও তো হতে পারে চাকরি ছেড়ে দিলে সিদ্ধার্থ ওকে নিয়ন্ত্রণ করবে, অথবা বলা তো যায়না কোনো কারণে সিদ্ধার্থর চাকরি চলে যেতে পারে কিম্বা চাকরি ছেড়ে রঞ্জা নিজেই অবসাদে তলিয়ে যাবে। সিদ্ধার্থ সরাসরি না বললেও রঞ্জা দেখেছে ওর যখনই ট্যুরে যাবার সময় আসে তখনই সিদ্ধার্থর জ্বর ভাব হয়, কোনো দরকারি ফাইল হারিয়ে যায় অথবা বাড়িতে অন্য কারোর ওপর অকারণ চেঁচামেচি শুরু করে। প্রথম দিকে দু একবার ট্যুর ক্যান্সেল করেছে রঞ্জা, তারপর মোটামুটি এটা রুটিনে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সে এসব না দেখার ভান করেই ট্যুরে চলে যায়। ফিরে আসার পর দু তিনদিন সিদ্ধার্থ একটু এড়িয়ে চলে, বাচ্চাদের মতো হাবভাব করে, রঞ্জা কিন্তু চেষ্টাও করেনা মানভঞ্জনের, তার এসব ড্রামাবাজী কোনোকালেই পছন্দ নয়। মা এবং সে জীবন যুদ্ধের সৈনিক, এই সমস্ত সস্তা মান অভিমানের কোনো অবকাশই ছিলনা তাদের জীবনে। ফলতঃ দু দিন বাদে তিন দিনের দিন সিদ্ধার্থই কথা শুরু করে আর রঞ্জাও যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বরের কথার উত্তর দেয়। এভাবেই তিন বছর কেটে যায়।

গত মাসেই একটু অসাবধান হয়ে পড়েছিল রঞ্জা, ওষুধটা খেতে একটু অনিয়ম করে ফেলেছিল, আর এর ফলেই এই গর্ভলক্ষণ। সে ভীষণ
দোটানায় পড়ে গেলেও সিদ্ধার্থের কিন্তু খুশীর অন্ত নেই। রঞ্জা বুঝতে পারছেনা এই খুশীর কতটা সন্তানের জন্য আর কতটাই বা স্ত্রীর অনিশ্চিত কর্ম জীবনের কথা কল্পনা করে! রাতের খাওয়া হয়ে গেলে ছাদে উঠে আসে রঞ্জা, পূর্ণিমার আলোয় গোটা ছাদ রূপোর মত ঝকঝক করছে। মা কে একটা ফোন লাগায় সে, ওদিক থেকে অঞ্জনা দেবী বলেন,
“কি রে মা, এতো ভালো খবর টা আমাকে জানাস নি? খুব খুশী হয়েছি রে কবে আসবি আমার এখানে?”

“মা কাল তো শনিবার, আমি কাল সন্ধেবেলায় যাবো, রাতে থাকবো, সেজন্যই ফোন করলাম। গুড নাইট।”

অঞ্জনা দেবী একটু অবাক হলেন, মেয়ের কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেলনা, বরং কিছুটা উদ্বিগ্ন মনে হল।

পরদিন অফিস থেকে হাজরা চলে গেল রঞ্জা, সিদ্ধার্থ কে বললো রাতে থাকবে। এখন যেন সিদ্ধার্থ রঞ্জা কে চোখে হারাচ্ছে। বললো রবিবার বিকেলে ও গিয়ে নিয়ে আসবে। শনিবার বারোটা নাগাদ রঞ্জা ও বাড়ি পৌঁছে গেল। অঞ্জনা দেবী মেয়ের প্রিয় কচু শাক নারকেল দিয়ে আর পমফ্রেট মাছের ঝাল বানিয়ে রেখেছেন। মেয়েটা চোখ বুঁজে আরাম করে খেল। তারপর দুপুরে মায়ের পাশে শুয়ে সে প্রথম কথাটা বললো,
“মা আমি কি চাকরি টা ছেড়ে দেবো?”

প্রচণ্ড চমকে উঠলেন অঞ্জনা দেবী,
“সে কি? কেন?”

“আমার কাজ টা খুব দায়িত্বের, ট্যুর, ক্লায়েন্ট মিটিং, লেট নাইট, এগুলো সামলে বাচ্চা কি করে মানুষ করবো মা?”

“কেন? ছেলেরা যে ভাবে করে! ওরা কি বাবা হওয়ার আগে এতো কিছু ভাবে? দিব্বি টুক করে বাবা হয়ে যায়!”

“আহা ওরা তো কোনো কিছুতেই মাথা ঘামায় না।”

“আর যত দায় আমাদের এই মেয়েদের? আচ্ছা মামণ, তুই দেখি বুড়োদের মতো কথা বলছিস। এতো পড়াশুনো করে এতোদূর উঠে শেষে এসব বলছিস?”

“বড্ড ভয় করছে মা, যদি সব দিক সামলাতে না পারি?”

“দরকার নেই তো সব দিক সামলানোর,  তুই শুধু নিজের দিকে মন দে। বাচ্চা ঠিক বড় হয়ে যাবে। আর আমি তো আছি, অবসর সময় কাটাবো কি করে ভেবেই পাইনা!”

রবিবার সিদ্ধার্থ বিকেলেই চলে এল। খুব যত্ন করে রঞ্জাকে বাড়ি নিয়ে গেল। অঞ্জনা দেবী নিশ্চিন্ত হলেন ঠিকই শুধু মনের কোণে একটা কাঁটা খচখচ করতে লাগলো, চাকরি না ছাড়ার সিদ্ধান্ত শুনে শ্বশুর বাড়ির সবাই কি ভাববেন! পরদিন অর্থাৎ সোমবার সিদ্ধার্থের ফোন সকাল নটা নাগাদ; কি? না হঠাৎ রঞ্জার হাই ব্লাড প্রেশার ধরা পড়েছে, ওরা ওকে নার্সিংহোমে নিয়ে গেছে। উনিও ছুটলেন মেয়েকে দেখতে। জানতে পারলেন সেদিন ওনার বাড়ি থেকে ফিরে বাথরুমে মাথাটা একটু টলে গেছিল রঞ্জার, পড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরেই চীৎকার করে সিদ্ধার্থকে ডাকতেই ও ছুটে যায়, তারপর রঞ্জা জ্ঞান হারায়। ওর একটু হাইপারটেনশন ছিলই, তারপর এতো স্ট্রেস। তবু অঞ্জনা দেবী মনে করেন এটা হয়ে একপক্ষে ভালো হলো, এই অবস্থায় একটু বিশ্রাম পাবে মেয়েটার শরীরটা।

নার্সিংহোমের ক্যাবিনে রঞ্জা আধশোয়া, সিদ্ধার্থ অসম্ভব চিন্তিত মুখে পাশের সোফায় বসে, অঞ্জনা দেবী ঢুকতেই রঞ্জার চোখে জল, মা মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন,”কোনো ভয় নেই রে মা, আমি তো আছি।”

সেদিন বিকেলে রঞ্জার এইচ আর ডিরেক্টর মিস্টার নায়ার সস্ত্রীক ওকে দেখতে এলেন। রঞ্জা উঠে বসতে গেলে মিসেস নায়ার ওর বিছানার পাশে গিয়ে ওর হাতটা ধরে আশ্বস্ত করলেন। সিদ্ধার্থ একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লো, এতো বড় একজন অফিসার বলে কথা! মিস্টার নায়ার কিন্তু একজন অভিভাবকের মতোই রঞ্জার সঙ্গে কথা বললেন। উনি বললেন,
“রঞ্জা, ডু নট থিঙ্ক অ্যাবাউট ইউর ওয়ার্ক নাও, জাস্ট রিল্যাক্স অ্যান্ড টেক কেয়ার অফ ইওর হেলথ।”
বললেন ওর কাজ পালিয়ে যাচ্ছে না, যদি বেশী দিন ছুটি প্রয়োজন হয় সেটাও মঞ্জুর হয়ে যাবে, এই রকম একজন দক্ষ কর্মী কে কম্পানী হারাতে চায় না। ভাঙা বাংলায় সিদ্ধার্থকে বললেন,
” বেবি এসে গেলে আপ থোড়া হেল্প করবে তো সিদ্ধার্থ বাবু? শি ইজ সো এফিশিয়েন্ট! উই নিড হার।”

সিদ্ধার্থ জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
“অবশ্যই, এ তো আমাদের দুজনেরই দায়িত্ব। আমি পাশে আছি।”

সেই রাতে রঞ্জা অনেক হাল্কা বোধ করলো। যেন মিস্টার নায়ারের মধ্যস্থতায় তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে জমে থাকা এক অদৃশ্য বরফের চাঁই গলে গেল, সিদ্ধার্থ নিশ্চই ওর পাশে থাকবে। দু দিন পরেই ওকে বাড়ি ছেড়ে দেবেন ডাক্তার বাবু। রাতে সিদ্ধার্থ সোফায় শুচ্ছে। ডিনারের পর হঠাৎ সে রঞ্জা কে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা মিসেস নায়ার কি জব করেন?”
রঞ্জা একটু অবাক হয়ে বলল,
“না তো! কেন?”

“না, মানে নিজের স্ত্রী কে ঘরে রেখে অন্যের স্ত্রী কে উপদেশ দিচ্ছেন বাইরে বেরোবার, কি অদ্ভূত না?”

রঞ্জার বুকের ভেতর একটা স্রোত বয়ে গেল, সিদ্ধার্থকে আবার কেমন অচেনা লাগছে। হঠাৎ কেন এই খোঁচা? এই কি নারী পুরুষের সমানাধিকারের নমুনা? সব সমান হলেও নারীর এই শরীরটা তো সম্পূর্ণ আলাদা, এর জন্যেই তো মেয়েদের এতো অপমান, কর্মরতা নারী মা হলে জ্বালা, বাড়ির বউ মা না হতে পারলে গঞ্জনা, বিবাহ বহির্ভূত গর্ভধারণে মেয়েদের কলঙ্ক, সন্তান আসার পর মায়েদের শরীরের আমূল পরিবর্তন, ঋতুস্রাবে লজ্জা,  এসব কি কখনো সমান ভাবে ভাগ করা সম্ভব? সব সময় শুধু মেয়েরাই অপরাধী, আজও! রঞ্জার বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করে, ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে,
“আমার সন্তান, আমার দেহ, আমার জীবন, আমি যা ইচ্ছে করবো, যেমন ভাবে খুশী বাঁচবো…!”
তারপরেই দু চোখ দিয়ে অসহায়তা গলে গলে পড়তে থাকে।

দু দিন পর বাড়ি ফিরেছে রঞ্জা। প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ওষুধ খেতে হচ্ছে এছাড়া আগামী মাসে একটা চেকআপ আছে তার গাইনীর কাছে। ডেলিভারির আগে প্রেশার নিয়ন্ত্রণে না এলে যে বিপদের সম্ভাবনা আছে সেটা রঞ্জা অনুমান করতে পারে। আপাতত তিনমাস তাকে বিশ্রামে থাকতে হবে, ডাক্তারের মতে বাচ্চাটা মোটামুটি একটা আকার ধারণ করলেই সে আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে। রঞ্জা এখন ঘুমের মধ্যে চমকে ওঠে, সে যেন কনফারেন্সে যাচ্ছে আর ফ্লাইট মিস করছে, অথবা  একা একা বোর্ড রুমে অপেক্ষা করছে, মিটিংয়ের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ কেউ আসছেনা। ঘুম ভেঙে দেখে পাশে সিদ্ধার্থ অঘোরে ঘুমোচ্ছে। নিজেই নিজের তলপেটে হাত বুলিয়ে প্রাণস্পন্দন অনুভব করার চেষ্টা করে রঞ্জা। আর ক মাস পরেই একটা আস্ত শরীর তৈরী হবে তার শরীরের মধ্যে, আম্বিলিকাল কর্ড দিয়ে জুড়ে থাকবে তারা। কি অদ্ভূত একটা অনুভূতি! আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় রঞ্জা।

সিদ্ধার্থ আজকাল বাড়ি ফিরে রঞ্জার সঙ্গে এক কাপ চা নিয়ে বসে। সারাদিনের খবর নেয়। অনেক নিশ্চিন্ত লাগে তাকে। যেন এই রকমই এক পরিপূর্ণ সংসার চেয়েছিল সে, বাড়ি ফিরে দেখবে স্ত্রী, সন্তান তার মুখ চেয়ে বসে আছে। রঞ্জা কিন্তু এই গৃহবন্দী জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে, এ ভাবেই কাটবে তবে বাকি জীবন? ডায়াপার পাল্টানো আর রান্না করা, রাতে স্বামীর সোহাগ আদর? এইচ আর ম্যানেজার রঞ্জা নিজেকে শক্ত করে। আসুক সন্তান তারপর দেখা যাবে। বিশ্বের উন্নত দেশের মেয়েরা সব সামলাচ্ছে কি করে? এই তো গত শীতে সিঙ্গাপুরের কনফারেন্সে আমেরিকা থেকে মিসেস জোন্স এসেছিলেন, তিন মাসের বেবী কে স্বামীর কাছে রেখে। ফ্রিজে তিন দিনের মতো ব্রেস্ট মিল্ক পাম্প করে রেখে এসেছিলেন, ও দেশে তো কাজের লোক ও নেই। ভিডিও তে দেখালেন বাবা কি সুন্দর সব সামলাচ্ছেন। তাহলে সিদ্ধার্থ পারবে না কেন?

যথা সময়ে নিরাপদে একটি ফুটফুটে মেয়ে এলো রঞ্জার কোল আলো করে। গাইনী মিসেস গুপ্তা সিদ্ধার্থ কে অভিনন্দন জানালেন। এর পরেই নার্স ও আয়ারা এসে ঘিরে ধরলো সিদ্ধার্থকে , বিরিয়ানী খাওয়ার বায়না। ঠিক সেই সময়েই নিউট্রিশনিস্ট মিষ্টি মেয়ে তৃপ্তি রঞ্জার খাবারের লিস্ট নিয়ে ঢুকলো, একসঙ্গে এতজন কর্মরতা, দক্ষ নারীর সামনে মেয়ে কোলে করে বসে থাকা সিদ্ধার্থকে বড্ড অসহায় লাগছিল। রঞ্জা সিদ্ধার্থের মন পড়তে পেরে বলে ওঠে,
“এই দ্যাখো, মেয়ে এক্কেবারে তোমার মতো মুখ পেয়েছে!”

গর্বিত পিতার মুখে তখন অপার্থিব আলোর চমক। এ আলোয় কেটে যাবে সব বৈষম্য, এ আলোয় পুরুষ উত্তীর্ণ হয় পিতৃত্বে।

কল্যাণী মিত্র ঘোষ

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 thoughts on “উত্তরণ

  1. এক নিঃশ্বাসে কতগুলো পড়ে ফেললাম আর গর্বে আনন্দে মন ভরে গেল, কত গুণী সই আমার পুকুর ঘাট এ???

    চরৈবেতী থেকে ফাটল, উত্তরণ
    হয়ে বাইরে পা,,,,,, একটার পর একটা অনবদ্য লেখা, কি ভালো ই যে লাগলো বলে বোঝাতে পারব না ভাই???
    সবাই কে অভিনন্দন আর ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছু পাওয়ার আশা নিয়ে রইলাম।
    জয় হো “পুকুরঘাট”👍💖

    1. দিদি অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার টিপস গুলো ও লা জবাব।

  2. শোভনা দির টিপস চিরন্তন। খুব ভালো লাগলো। চরৈবেতি ভালো লাগলো জেনে শোভনা দিকে ধন্যবাদ । ভালবাসা নেবেন দিদি।

  3. এমন উত্তরণ ঘটুক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের,বাবা ও মা ভাগ করে নিক ঘরে বাইরের সব দায়।বহু লড়াই এর পর পূর্বজ রা যা অর্জন করেছে তা অনেকটা শোভনাদির টিপস অনুযায়ী।ফাটল সব জুড়ে যাক সম্পর্কের।

    1. অসংখ্য ধন্যবাদ, সত্যিই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার যুগ এটা, সকলের স্বপ্ন সত্যি হোক।

  4. সিদ্ধার্থ রায় বুঝতে পারুক সাম্যতা র অর্থ।
    ভালো লাগল।

  5. এমন উত্তরণ হোক সব ‘পিতা’র। খুব সুন্দর গল্প।

  6. প্রায় এক নিশ্বাস এ পড়ে ফেললাম. একটা ভয় কাজ করছিলো, বাকি গল্পের মত এটাও কী বাঁধা গতে দিকে যাবে? কিন্তু না, লেখিকা খুব সুন্দর করে চেনা ফাঁদ এড়িয়ে একটা সুন্দর সমাপ্তি উপহার দিলেন.