অনয়

অনয়

সুনেত্রা সাধু

 

 

প্রাসাদ শীর্ষে স্বর্ণকলসের অগ্রভাগে উড্ডীয়মান ধ্বজার পানে কীয়ৎক্ষণ চাহিয়া উন্মীলিত চক্ষু নামাইয়া আনিল রাজবধূ অম্বিকা। মৃদুমন্দ বাতাস বহিতেছে,  উষ্ণতা অন্তর্হীত হইয়া উহাতে হিমের পরশ লাগিয়াছে।  এক পক্ষকাল বিগত হইলে দীপাবলী আসিয়া পড়িবে, সেইদিন মহালক্ষ্মীর পূজায় মাতিবে সমগ্র নগরবাসী। দীপালোকে রাত্রিকাল দিন বলিয়া ভ্রম হইবে। শুধুমাত্র রাণী অম্বিকার কক্ষ রহিবে নিষ্প্রদীপ। সেথা বিরাজ করিবে নিকষ অন্ধকার। সেই কথা ভাবিতেই অম্বিকার ওষ্ঠে একটি করুণ হাসি খেলিয়া গেল। জোর পূর্বক সেই চিন্তা হইতে মনকে মুক্ত করিয়া সে বাহিরে দৃষ্টি ফিরাইল।
পক্ষীকুল মহা কলরবে বাসায় ফিরিতেছে। ক্রমে নিস্প্রভ হইয়া আসিতেছে বিগত বৈকালের তাম্রবর্ণ আলোক। বৈদেহী নগরীর গৃহে গৃহে জ্বলিয়া উঠিতেছে ঘৃত-প্রদীপ। শঙ্খধ্বনি করিয়া বধুগন আবাহন করিতেছে গৃহলক্ষ্মীকে। প্রতিহারিণী পরিবৃতা হইয়া দুই রাণী চলিয়াছেন ক্ষিরোদসম্ভবা মন্দিরে। তাহাদের অঙ্গে পট্টবস্ত্র, গাত্রে স্বর্ণালঙ্কার , কবরীবন্ধে শ্বেত মালিকা। দুই রাণীর পশ্চাতে চলিয়াছেন সাত দাসী। তাহাদের হস্তে স্বর্ণস্থালী ;  রহিয়াছে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ, নানাবিধ পূজা উপাচার।   প্রাসাদশীর্ষ মুক্ত অলিন্দে দাঁড়াইয়া উহাই প্রত্যক্ষ করিতেছিল অম্বিকা। তাহার মস্তক অনব-গুন্ঠিত, আলুলায়িত ঘন কেশরাজি মুক্ত পৃষ্ঠদেশ আবৃত করিয়া রাখিয়াছে , আঁচলের প্রান্তভাগ ভূলুন্ঠিত। সংবরণের প্রয়োজন নাই, কাহারো দৃষ্টি এই স্থান অবধি পৌঁছিবে না। প্রাসাদ শীর্ষ কক্ষে সে একেলা। না, পূর্ণ একেলা নহে; ক্ষেত্রমণি নামক এক কিঙ্করী বলবৎ রহিয়াছে পরিচর্চা ও প্রহরার কার্যে। সে এক্ষণে অনুপস্থিত, পাকশালে ক্ষীরের মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিতে তাহার ডাক পড়িয়া থাকে, এই কার্যে ক্ষেত্রমণি বিশেষ পটু। সে  ফিরিবে রাত্রিকালের আহার্য সঙ্গে লইয়া।
ক্ষেত্রমণি কক্ষে না থাকিলে অম্বিকা ইচ্ছা করিয়া অলক্ষ্মীর ন্যায় কার্য করিয়া থাকে। যেমন সন্ধ্যাকালে  ক্ষিরোদসম্ভবা মন্দিরে আরতির বাদ্য বাজিয়া উঠিলে  আলুলায়িত কেশরাজি গজ দন্তের কঙ্কতিকা দিয়া কর্ষণ করিয়া উন্মূলিত কেশগুচ্ছ বাতাসে উড়াইয়া দেয়। দ্বিপ্রহরের অভুক্ত আহার্য লইয়া সন্ধ্যাকালে খাইতে বসে অথবা কেশ এলাইয়া শুইয়া থাকে। অলক্ষ্মী ন্যায় কার্য করিয়া সে দেখিতে চাহে সত্যই ইহা অমঙ্গলকারী কিনা…।
তবে আজ অম্বিকার মন ভালো নাই। পূর্ব কথা স্মরণে আসিতেছে,  তাহার ন্যায় বিদূষী রাজকন্যার এই অবস্থা হইবে কেহ স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই, সকলি অদৃষ্ট। অম্বিকার মন খারাপ হইলে  সংলগ্ন আম্রবাটিকা হইতে একটি বপপীহ পক্ষী করুণ স্বরে পিয়া পিয়া পিয়া রব তুলিয়া ডাকিয়া উঠে , আজও ডাকিল। শুনিয়া অষ্টাদশী যৌবনবতী অম্বিকার চক্ষে জল আসিল, তাহার কেহ নাই।  পট্টমহিষীর পদমর্যাদা সে লাভ করিতে পারে নাই।  সে নিঃসন্তান, রাজ অনুগ্রহ হইতে বঞ্চিত। সে রাজবধূ তথাপি রাজার বক্ষলগ্না হইবার সুযোগ কদাপি ঘটে নাই। প্রথম দিন হইতেই সে প্রাসাদশীর্ষে বন্দী, সকলের চক্ষে রাণী অম্বিকা অলক্ষ্মী ।
আকাশে পূর্ণ চন্দ্র উদিত হইয়াছে। হীমাবতী নদীর ধূসর প্রবাহে লাগিয়াছিল শ্বেতাভ বিভা। তীরবর্তী প্রাসাদগুলির দীপরশ্মী হীমাবতীর জলে প্রতিফলিত হইয়া উহাকে অধিক মোহময়ী করিয়া তুলিয়াছে। সেই আলোকে পরিস্ফুট নক্ষত্র আজ ম্রিয়মাণ। একটি ময়ূরপঙ্খী নৌকা  তীর চুম্বন করিয়া ঢেউয়ের আঘাতে মৃদু মৃদু আন্দোলিত হইতেছে। পার্শ্বে কতকগুলি গোলাকৃতি ডিঙা বাঁধিয়া রাখা, তাহাদের মধ্যে একটি ডিঙা রাণী অম্বিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল।  ডিঙাখানি পদ্মাকৃতি, যেন হীমাবতী নদীতে ফুটিয়া আছে এক বিশালাকৃতির পদ্ম। অম্বিকার ইচ্ছে করিল ওই ডিঙাখানি লইয়া পলায়ন করিতে। নিজ ইচ্ছের কথা ভাবিয়া করুণা হইল। পলায়ন করিয়া সে যাইবে কোন স্থানে ? বিগত দুই বৎসর অম্বিকা প্রাসাদশীর্ষ কক্ষ হইতে অবতরণ করে নাই। কেহ অলক্ষ্মীর মুখ দর্শন করিতে চাহে না। প্রতিহারিণীদের প্রহরা বহুদিন হইল শিথিল হইয়াছে। তাহারা খোশগল্প করিয়া কালাতিপাত করিয়া থাকে। তাহারাও বুঝিয়াছে অলক্ষীকে বিদায় না করিলে সে নিজ ইচ্ছায় রাজ্য ছাড়িয়া বাহির হইবে না।  অম্বিকা পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়িল, হয়তো অলক্ষ্মীর বদনাম হইতে ইহ জনমে তাহার মুক্তি নাই।
অম্বিকার ক্ষুধাবোধ হইতেছিল সে ক্ষেত্রমণিকে স্মরণ করিল, কিয়ৎকাল অতিবাহিত হইল মাত্র ক্ষেত্রমণি নিঃশব্দে অশ্রুপাত করিতে করিতে অম্বিকার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। সে আজ নিশ্চুপ। অশ্রু দেখিয়া অম্বিকাও ক্ষুধাবোধের কথা কহিতে পারিল না।  চন্দ্রালোকে নিমজ্জিত হইয়া দুই অসমবয়স্ক  রমনী নদীর দিকে তাকাইয়া রহিল। অম্বিকার মনমধ্যে ক্ষেত্রমণির অশ্রুপাত লইয়া কোনপ্রকার কৌতুহলের উদয় হইল না, নির্বাসন তাহাকে নির্লিপ্তি দিয়াছে। কিছুক্ষণ গত হইলে ক্ষেত্রমণি বলিল,
“ সমূহ  বিপদ, দেশে যুদ্ধ আসন্ন। ভল্ল দেশের রাজা  বিবস্বান্ বৈদেহী নগরীর অদূরে হীমাবতীর তীরে দশ সহস্ত্র সৈন্য লইয়া শিবির স্থাপন করিয়াছেন। প্রতিবেশী রাজ্যগুলিও তাহাকে সাহায্য করিতেছে, তাহাদের মধ্যে অস্মক প্রদেশের রাজা রুদ্রদেব রহিয়াছেন।  আজ দূত আসিয়াছে যুদ্ধের সংবাদ লইয়া। রাজ্যে রক্তগঙ্গা বহিবে, দীপাবলিতে ক্ষিরোদসম্ভবা মন্দিরে দীপ জ্বালাইবার নিমত্ত কেহ বাঁচিয়া থাকিবে না।”
অম্বিকার সুষুম্নায় একটি শীতল স্রোত বহিয়া গেল, তাহার চক্ষু হইল উজ্জ্বল, কর্ণ হইল সজাগ, নির্লিপ্তির সুষুপ্তি স্থল হইতে জাগিয়া উঠিল বৈদেহী নগরীর অলক্ষ্মী।
                                ২
দুই বৎসরকাল পূর্বের কথা, অস্মক প্রদেশে পরম স্নেহে লালিত হইতেছিল রাজা রুদ্রদেবের কন্যা। তিনি কন্যাকে পুত্রতুল্য মর্যাদা দিয়া প্রতিপালন করিয়াছিলেন। সেই রাজকন্যা সর্বগুণসম্পন্না,বিদ্যাশিক্ষায় অতীব পারদর্শী, বিশেষত রাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির বিবিধ কৌশল  তাহার নখদর্পনে। পিতা রুদ্রদেব নানাপ্রকার পরামর্শ কন্যার নিকট হইতে গ্রহণ করিতেন।  যুদ্ধ বিদ্যা নিপুণ ষোড়শী রাজকন্যা  হইয়া উঠিয়াছিল অস্মক প্রদেশের অদৃশ্য রক্ষক।
একদা সেই রাজকন্যা অরণ্যমধ্যে একাকিনী অশ্বারোহণে চলিয়াছে। তাহার পরনে রক্তাভ বস্ত্র, কর্ণে মাণিক্যের অবতংস, পৃষ্ঠে সর্পের ন্যায় কৃষ্ণ বেণী, কোটিতে তরবারি, এক হস্তে ধনুর্বাণ ; রাজকন্যার এ হেন আলোকলতাসম রূপে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে ছায়ান্ধকার বনপথ। মৃগয়া তাহার উদ্দ্যেশ্যে নহে সে আসিয়াছে অরণ্য পরিদর্শনে। সন্ধ্যাকাল সমাগত, বিপুল বেগে অশ্বচালনা করিয়া রাজকন্যা ফিরিতেছিল অস্মক নগরীতে। সহসা সে লক্ষ্য করিল অপর এক অশ্বারোহী সবেগে তাহারই পশ্চাতে ছুটিয়ে আসিতেছে। আত্মরক্ষার ভীতি রাজকন্যার নাই, সে দাঁড়াইয়া পড়িল। তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল এক অনিন্দ্যকান্তি পুরুষ।
-“আপনি নারী! কোথা হইতে আসিয়াছেন? সন্ধ্যাকালে অরণ্য মধ্যে একাকী ভ্রমণ করিতেছেন আপনার ভয় নাই?”
-“আমি অস্মক প্রদেশের রাজকন্যা, আত্মরক্ষা করিতে শিখিয়াছি। ভয় নাই। আপনার পরিচয় জানিতে পারি?”
-“অচিরেই জানিতে পারিবেন,” বলিয়া সবেগে অশ্বচালনা করিয়া অদৃশ্য হইল সেই দেবপ্রতিম পুরুষ।
পরদিন অস্মক প্রদেশের রাজসভায় বৈদেহী নগরীর রাজা সুরবর্মা নিকট হইতে দূত আসিল বিবাহ প্রস্তাব লইয়া। রাজা সম্মত হইলেন কারণ রাজকন্যাও সানন্দে সম্মতি জানাইয়াছেন। দুই প্রতিবেশী রাজ্য পারিবারিক মৈত্রী স্থাপন করিয়া শক্তি বৃদ্ধি করিবে বলিয়া মনস্থ করিল। শুধুমাত্র রাজ জ্যোতিষী বিবাহকালে কিঞ্চিৎ বিলম্ব ঘটাইবার কথা বলিয়াছিলেন, তাহার কথা মান্যতা পাইল না। উভয় পক্ষই বিবাহে বিলম্ব চাহিল না। যাগযজ্ঞ করিয়া বাধা কাটাইবার ব্যবস্থা হইল মাত্র। রাজা সুরবর্মার সহিত বিবাহ হইয়া গেল রাজকন্যা অম্বিকার। সেই যাগযজ্ঞ অবশ্য বিফল হইল, রাজ জ্যোতিষী নির্ভুল অচিরেই তাহার প্রমাণ মিলিল। মাল্যদানের মুহূর্তে সংবাদ আসিল বৈদেহী নগরীর রাজমাতার আকস্মিক মৃত্যু ঘটিয়াছে। সমস্ত আনন্দ নিস্প্রভ হইল, গীত বাদ্য থামিল, নগরবাসী অভুক্ত রহিয়া গৃহে ফিরিল। রাজা সুরবর্মা রাণী অম্বিকাকে লইয়া বৈদেহী নগরীতে ফিরিলেন। রাজবধুকে কেহ আমন্ত্রণ জানাইল না, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা হইল না, তোরণ উড়িল না, যন্ত্রবাদকেরা মৃদঙ্গ, মুরলী, পাখোয়াজ বাজাইল না। নগর জুড়িয়া শোকের আবহ। রাজপুরীতে কেহ বরণ করিতে আসিল না, দ্বারে শস্যপূর্ণ কলস রাখিল না। সেই দিবস হইতে অম্বিকা অলক্ষ্মী রূপে চিহ্নিত হইল। কোন মন্ত্রণাদাতা প্রাসাদ শীর্ষে নির্বাসনের অধ্যাদেশ  দিয়াছিলেন তাহা অম্বিকার জানা নাই, সেই দিবস হইতে এক মুহূর্তের লাগিয়াও রাজার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয় নাই। বোধকরি বৈদেহী নগরবাসীও এতদিনে অম্বিকার কথা  বিস্মৃত হইয়াছে।
                              ৩
রাত্রির তৃতীয় প্রহর বিগতপ্রায়, দীপগুলি একে একে নিভিয়া গিয়াছে। নীরন্ধ্র অন্ধকারে অবসন্ন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নগরবাসী নিদ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। শুধুমাত্র অম্বিকার চক্ষু নিদ্রাহীন। তবে কি পিতা তাহার দূর্দশার কথা জানিয়া ভল্ল রাজ বিবস্বানের সহিত মিলিত হইয়া যুদ্ধ ঘোষণা করিল? ইহা কি উচিত হইল? বৈদেহী নগরী অম্বিকার পতিগৃহ, উহাকে বাঁচাইবার ভার কি নিজ স্কন্ধে লওয়া অন্যায়? অম্বিকা কিরূপে একাকী দশ সহস্র সৈন্যের বিরুদ্ধে রূখিয়া দাঁড়াইবে? না না অন্য কৌশল অবলম্বন করিতে হইবে। ছিদ্রপথ অন্বেষণের প্রয়োজন। কিঙ্করী ক্ষেত্রমণি কক্ষের বাহিরে শয্যা পাতিয়া ঘুমাইতে যায়, তাহাকে জাগাইবার নিমিত্ত অম্বিকা উঠিয়া পড়িল।
“ক্ষেত্র, ক্ষেত্র… আমাকে কিঞ্চিৎ সাহায্য করিতে পারিস? এই যুদ্ধ থামাইতে হইবে। চেষ্টা করিয়া দেখিতে চাহি।”
ক্ষেত্রমণি নিদ্রালু চক্ষে হতবাক হইয়া অম্বিকার মুখপানে চাহিয়া রহিল। “দশ সহস্র সৈন্যকে তুমি রুখিবে? বৈদেহী নগরীর অলক্ষী? তোমার সে ক্ষমতা কোথা? ”
“দোহাই ক্ষেত্র, যদি রাজ্য বাঁচাইবার অভিপ্রায় পোষণ করিয়া থাকিস তবে অশ্রুপাত না করিয়া একটি চরের সন্ধান করিয়া দে। তাহাকে কৌশলে ভল্ল রাজ-সৈন্যের বেশে শত্রু শিবিরে পাঠাইবি। তাহার কার্য হইবে প্রত্যুষ কাল হইতে রাত্রিকাল অবধি ভল্ল রাজার গতিবিধি নিরীক্ষণ। রাজার চারিত্রিক দূর্বলতার অনুসন্ধান করিতে  হইবে। বুঝিয়াছিস?  এক্ষণে যা..”
প্রভাত হইল, পক্ষীকূল কলরব করিল না, মন্দিরে ঘন্টাধ্বনি হইল না, রাজ প্রাঙ্গনে মল্লযুদ্ধের আসর বসিল না, হীমাবতীর ঘাটে হাস্যোজ্জ্বল রমণীগণের দেখা মিলিল না,  নগরীতে হাট বসিল না। তোরণদ্বারে গিরি গিরি শব্দে দুন্দুভি বাজিতে থাকিল। ভান্ডারে মজুত অস্ত্রসস্ত্র শাণিত হইল, বর্ম শিরোস্ত্রাণ পরিধান করিয়া সৈন্যদল যুদ্ধ অভ্যাস করিতে লাগিল। হাতিশাল, ঘোড়াশালে মহা সোরগোল পড়িল। এমতাবস্থায় রাজা সুরবর্মার মানসিক অবস্থার খোঁজ রাণী অম্বিকা পাইল না। সে চরের লাগিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল। আহার্যে তাহার মতি নাই, চক্ষে নিদ্রা নাই।
পরদিন প্রত্যুষে ক্ষেত্রমণি আসিল সংবাদ লইয়া। চর ফিরিয়াছে, সে জানাইয়াছে ভল্ল দেশের রাজা বিবস্বান্ অতীব শক্তিধর। শুধুমাত্র দশ সহস্র দক্ষ সৈন্য নহে তাহার ভান্ডারে মজুত রহিয়াছে আধুনিক অস্ত্রসস্ত্র। বৈদেহী নগরীর বিনাশ ঘটিতে বিলম্ব নাই। তবে রাজা ধর্মপ্রাণ, দেবী চন্ডিকার উপাসক। প্রত্যহ ব্রাহ্মমুহূর্তে   একাকী নদীতে অবগাহন করিয়া ধ্যান যপ সম্পন্ন করিয়া থাকেন।
“ধর্মপ্রাণ? চন্ডির উপাসক? বেশ। ক্ষেত্র, দুইখানি ক্ষীরের হস্তী তৈয়ার করিয়া দিতে হইবে।”
“হস্তী? সে তো প্রকান্ড! কিরূপে সম্ভব হইবে?”
“প্রকান্ড নহে এক হস্ত পরিমাপ বানাইবি। রাত্রিকাল শেষ হইলে আমি বাহির হইব, ফিরিয়া আসিব প্রত্যুষে। আমাকে হীমাবতী নদীর ঘাট অবধি পৌঁছাইয়া দিবার দায়িত্ব তোর… ”
“যদি পলায়ন করো?”
“ভয় নাই। লক্ষ্মী চঞ্চলা, অলক্ষ্মী নহে,” বলিয়া করুন হাসি হাসিল অম্বিকা।
রাত্রিকালের আহার পর্ব মিটিলে পাকশাল নির্জন হইল। পাচক ও কিঙ্করীগণ ঘুমাইয়া পড়িলে মজুত ক্ষীর দিয়া হস্তী নির্মাণ করিতে বসিল ক্ষেত্রমণি। অপর দিকে শীর্ষ মহলে বহুকাল অন্তে অম্বিকার তোরঙ্গ খুলিল। বাহির হইল রক্তাভ পট্ট বস্ত্র। অলক্তরাগে রঞ্জিত হইল পদযুগল। গাত্রে উঠিল স্বর্ণালঙ্কার, আলুলায়িত মুক্ত কেশরাজি ঢাকিয়া দিল পৃষ্টদেশ। দর্পণে মুখ দেখিয়া শিহরিত হইল অম্বিকা। দুই বৎসর কাল অন্তর্দাহে দগ্ধ হইয়াও রূপ এতটুকু মলিন হয় নাই। হিমশুভ্র পান্ডুরতায় ঈষৎ ক্লান্ত শিথিলতায় করুণ চাহনিতে রূপ আরও অনির্বচনীয় হইয়া উঠিয়াছে। প্রসাধন শেষ হইলে অম্বিকা কটিতে একটি ছুরিকা বাঁধিয়া লইল। এটিও তাহার বস্ত্রাদির সহিত অস্মক প্রদেশ হইতে আসিয়াছিল। ক্ষেত্রমণি আসিল দুইটি ক্ষীরের হস্তী লইয়া। সকল উপযোগ সম্পন্ন  হইলে দুই রমণী হীমাবতীর ঘাটের উদ্দেশ্যে বাহির হইল।
রাজপ্রাসাদে চৌষট্টি দ্বার, তাহার মধ্যে অধিকাংশই গুপ্ত, ক্ষেত্রমণি সেই সকল দ্বারের সন্ধান রাখিত। প্রায়শই  গুপ্ত দ্বার দিয়া সে নাগরের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইত। সেইরূপ একটি গুপ্ত দ্বার দিয়া শনৈঃ শনৈঃ অগ্রসর হইল দুইজন। জ্যোৎস্না প্লাবিত মুক্ত প্রাঙ্গণ দ্রুত পদে অতিক্রম করিয়া অম্বিকা পৌঁছিল হীমাবতীর ঘাটে। সেই পদ্মাকৃতি ডিঙাখানিতে চড়িয়া সেটি ভাসাইয়া দিল, সঙ্গে রহিল দুইখান ক্ষীরের হস্তী।
ভল্ল দেশের রাজা বিবস্বান্ ব্রাহ্মমুহুর্তে হীমাবতীর ঘাটে আসিয়া পৌঁছিলেন। নদীতীরবর্তী এই অঞ্চলেই তিনি শিবির স্থাপন করিয়াছেন। বৈদেহী নগরী এই স্থান হইতে পাঁচ ক্রোশ দূরে। অস্তমিত চন্দ্রের অপরিস্ফুট আলোকে নদীর উপরিভাগ শ্বেতাভ কুজ্ঝটিকায় আচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। দূরবর্তী শিবিরে এখনো ধুনি জ্বলিতেছে, সেই আলোক ঘাট অবধি পৌঁছিবে না। রাজা বিবস্বান্ বক্ষসমান জলে দাঁড়াইয়া স্ত্রোত্র পাঠ করিতে লাগিলেন। দুই করতলে হীমাবতীর জল। সহসা পদ্মাসনা এক দেবী মূর্তি আবির্ভূত হইল। সেই অনির্বচনীয় মাতৃমূর্তি দেখিয়া রাজা  বিবস্বানের চক্ষে ঘোর লাগিল। পদ্মাসনা সেই দেবী দংষ্ট্রাবিকাশ করিয়া হাসিতে হাসিতে এক হস্তে হস্তী লইয়া গিলিতে আরম্ভ করিলেন। বিবস্বান্ অস্ফুটে কহিলেন “কমলে কামিনী!!!”
দেবী হস্তী ভক্ষণ সমাপন করিয়া তর্জনী উঠাইয়া  বলিলেন “আমি বিকশিত পদ্মের ন্যায় সুকোমলা, সুপবিত্রা নারী, আমিই জগজ্জননী। ধনলিপ্সু, ক্ষমতালোভী, কামলুদ্ধ পুরুষ যদি বৈদেহী নগরীর পানে মদমত্ত হস্তীর ন্যায় ধাইয়া আসে আমি তাহাকে গলাধঃকরণ করিব। সে ধনে প্রাণে শেষ হইবে।”
“হে দেবী মঙ্গল-চন্ডিকা আমি আপনার উপাসক, ক্ষমা করুন মাতেঃ, আমি ফিরিয়া যাইব।” কম্পিত কন্ঠে ভল্ল রাজ মিনতি করিল।
অম্বিকার ওষ্ঠে যুদ্ধ জয়ের হাসি।  অপর একটি হস্তী পার্শ্বেই ছিল সেটিকে উদগার করিবার ভঙ্গিমায় মুখের সম্মুখে ধরিল অম্বিকা, অপর হস্তে তখন বরাভয় মুদ্রা। রাজা বিবস্বান্ করজোড়ে নতমস্তকে প্রণাম জানাইলেন। সেই অবসরে দ্রুত বেগে ডিঙা ভাসাইয়া ফিরিয়া আসিল অম্বিকা। বৈদেহী নগরী নিদ্রামগ্ন, কেহ কিছুই জানিতে পারিল না। অম্বিকাকে ফিরিতে দেখিয়া ক্ষেত্রমণি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল, তাহার গর্দান সুরক্ষিত রহিল।
অম্বিকা তোরণদ্বারের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল, দিবা দুই প্রহর অতিক্রান্ত হইলে প্রবল বেগে অশ্বচালনা করিয়া শ্বেত ধ্বজা উড়াইতে উড়াইতে ভল্ল রাজার দূত সন্ধি প্রস্তাব লইয়া আসিয়া পৌঁছিল বৈদেহী নগরে। নগরগুঞ্জন কোলাহলে পরিনত হইল, সকলে জানিল মন্দির মধ্যস্থ পদ্মাসনা ক্ষিরোদসম্ভবার পাষাণ মূর্তি জাগরিত হইয়া বৈদেহী নগরীকে রক্ষা করিয়াছেন। তোরণদ্বারে জয় ডঙ্কা বাজিয়া উঠিল। মন্দিরে শুরু হইল মহাযজ্ঞ, ফুলমাল্যে সাজিয়া উঠিল নগরীর প্রতিটি অট্টালিকা। সন্ধ্যাকালে মন্দিরে আরতি বাদ্য বাজিল, ঘৃত-প্রদীপে সাজিয়া উঠিল বৈদেহী নগরী। ইহা যেন এক অকাল দীপাবলি। শুধুমাত্র রাণী অম্বিকার শীর্ষ প্রাসাদ পূর্বের ন্যায় নিস্প্রদীপ রহিল। কেহ জানিল না অলক্ষী অম্বিকার লক্ষ্মীমন্ত রূপের কথা। জানিবার ইচ্ছাও কাহারো ছিল না, তাহারা মনুষ্য মধ্যে দেবতার সন্ধান করে নাই, করিয়াছে প্রস্তর মূর্তিতে । সেই ধারা আজও অব্যাহত। অম্বিকার ন্যায় কত সহস্র অলক্ষ্মী নাম্নী নারী শুধুমাত্র তাহার নিজস্ব রাজ্যপাট বাঁচাইবার নিমিত্ত নিরন্তর প্রাণপাত করিতেছে তাহাদের খোঁজ কয়জন রাখে?
সুনেত্রা সাধু
পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *