আমায় তুমি লক্ষ্মী বলো

আমায় তুমি লক্ষ্মী বলো

শ্যামলী আচার্য

 

 

মাঠের অনেকটা অংশ জুড়েই কাশফুল। ঘাস আর দেখা যায় না বললেই চলে। মিষ্টু আর রুমন দুজনের দিকে তাকায় একবার। ভাবখানা এমন, আর দেরি কীসের?

 মোবাইল ক্যামেরার সেলফি মোডে পৌঁছতে টিপছাপ দেবার চেয়েও কম সময় লাগে। আর বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলে সেসব সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে মিনিট কয়েক। ছবি দেখানোর, লুকোনোর নয়।

ছবিগুলো পোস্ট করে ফেসবুক দেখতে দেখতেই একটা পোস্টে চোখ আটকে গেল মিষ্টুর। একজন লিখেছেন, লব কুশ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে বংশ থেকে তাঁদের মা’কে গর্ভবতী অবস্থায় তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেই বংশের কাউকে তাঁরা আর জল দেবেন না। সীতা নাকি তা’ও দশরথের জন্য জল রেখেছিলেন। কিন্তু রাম-লক্ষ্মণকে জল দেওয়ার সময় কুশের আংটি অনামিকা থেকে খুলে রাখতে হয়। এমনটিই প্রথা।

“আচ্ছা এটা তুই জানতিস?”

বেমক্কা প্রশ্ন করেই চুপ করে যায় মিষ্টু। রুমনের জানার কথা নয়। রুমন নিশ্চয়ই এসব কিচ্ছু জানে না। কী করে জানবে? রুমনের মা’কে তার ছেলেসহ ঘাড়ধাক্কা দিয়ে কেউ কোনওদিন তাড়িয়ে দিয়েছে বুঝি? বরং রুমনের মা’কে ওই বাড়ির কর্ত্রী মনে হয়। দশভুজার মতো। চারদিক আগলে রেখেছেন। হাঁকডাক নেই। ধীর স্থির শান্ত। অথচ সবদিকে সমান লক্ষ্য।

মিষ্টুর প্রশ্নটা ততক্ষণে রুমনের কাছে চলে গেছে। “কী জানতে হবে আবার? যে বেশি জানে তাকে কী বলে বল তো?”

 “জ্ঞানী বলে, আবার কী বলবে… পণ্ডিতও বলতে পারে।”

 মিষ্টুর উত্তরে রুমন খিকখিক করে হেসে বলে, “হয়নি, হয়নি। ফেল ফেল। যে খেলে, সে যদি খেলোয়াড় হয়, তবে যে জানে সে কী হবে? ওই একই ফর্মুলায়… হে হে হে…”

 মিষ্টু চড় দেখায় একটা। “তোর জীবনে সিরিয়াস কিছু নেই?”

 “এই তো আছে,” বলতে বলতেই রুমন গম্ভীর গলায় বলতে থাকে, “এই যে চারপাশের অপূর্ব ইয়ে, মানে নেচার, আসলে যাকে বাংলায় বলে প্রকৃতি… এর মধ্যে কাশফুল মেঘ আর নীল আকাশ … আহা হা পুরো ছবি ছবি। এসব দেখেই কে যেন বলেছেন, মেঘের কোলে রোদ উঠেছে, নীল আকাশে কে দোলালে… নিশ্চয়ই রবি ঠাকুরই বলেছেন, উনি এমন বহু কিছু বলে গেছেন, যা আমরা রেগুলার কোটেশনের মতো টুকি…”

“এই রুমন থাম। রবীন্দ্রনাথকে আর টানিস না। মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, ওঠেনি। নীল আকাশে কে ভাসালে। দোলানোর কিছু নেই। তুই একটা যাচ্ছেতাই। ভুল কোটেশন বসালে নম্বর কাটব বলে দিলাম।”

“এই যযাঃ… স্যরি রে… ভুলেই গিয়েছিলুম তুই ইয়ে, মানে ওই আসলে সব জানিস”, বলেই চোখ মটকে তাকায় রুমন। মিষ্টু “তবে রে” বলে কিল বাগিয়ে তাকায় ওর দিকে। ওর ঘাড় হেলানো ভঙ্গিটি বড় মনকাড়া।

মহালয়ার দিন বলেই ছুটি। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। এমনিতে বেসরকারি অফিসে দুর্গাপুজোর দিনেও নতুন জামা পরে এসে অফিস করতে হয়। সকলকে হাসিমুখের ছবি দেখাতে হয়। তা’ না হলে ওপরতলার কর্তারা সব নোট করে রাখেন। কার জন্য যে কী বরাদ্দ সর্বশক্তিমান ওপরওয়ালাও জানেন না। এইরকম একটি বেরসিক অফিসের দুই সহকর্মী ছুটির মেজাজে শহর ছেড়ে কাশফুল দেখতে পাড়ি দিয়েছে। মফঃস্বল এখন আর ততটা মফঃস্বল নয়। মিষ্টু আর রুমনের স্থির বিশ্বাস কাশফুলও এখন আর আগেকার মতো সাদা হয় না। তার মধ্যে দূষণের ধূসরতা। তবুও। কাশ আর আকাশের মিঠে গল্প শুনতে দুজনের আজ ঘর ছেড়ে বেরোনো। আর হয়র জীবন খুঁজে পাবার প্রত্যাশায়।

ফেসবুক পোস্টটা না পড়লেই হত। কে একজন লিখেছেন। তাঁর নাম কল্লোল। তিনি অজানা, অচেনা। তবু আছেন বন্ধুতালিকায়। বা ঠিক বন্ধু অর্থে নয়, কিন্তু আছেন। তিনি দিব্যি লিখলেন লব-কুশ জল দেয়নি পিতৃপুরুষকে। হতে পারে। না দেওয়াই স্বাভাবিক। মা’কে যদি কেউ অমন করে তাড়িয়ে দেয়…

 “শুনেছি আমাদের দেশের বাড়িতে এককালে দুর্গাপুজো হত। সেখানে একটা নদী আছে। আর গ্রামের একদিকের বিলে পদ্মফুল ফুটত। সেই নদীর পাড়ের কাশবন কী এমন দেখতে ছিল? আমার মাঝে মাঝে খুব যেতে ইচ্ছে করে…”

মিষ্টুর উদাস কথার সুরে খেয়ালের তান। রুমন বলে, “একবার গেলেই পারিস।”

“আরে দূর, তা’ কী করে হবে? এখন তো সেই দেশ মানে বিদেশ। পাসপোর্ট চাই, ভিসা চাই। চাইলেই যাওয়া যায় না। তারপর যদি বা গেলাম, নির্ঘাত দেখব বিল বুজিয়ে দিয়েছে। পদ্ম ফোটে না। নদী পাশ ফিরে অন্য কোথাও বাঁক নিয়েছে। মানেই হয় না।”

 বাইকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রুমন। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গিয়ে বসে পড়ে। ওঠার সময় জিনসটা একটু ঝেড়ে নিলেই হবে। “বসে পড় এসে। পরিষ্কার আছে,” রুমন ডাকে, “কী রে মিষ্টু…”

মিষ্টু ভুরু কুঁচকে তাকায়।

 সকলে অফিসে ওর নাম দিয়েছে মিষ্টু। মিষ্টি খেতে ভালোবাসে বলে নয়, মিষ্টি দেখতে বলেও নয়। মিষ্টি ব্যবহার? নাঃ। ওকে একটা নাম দেওয়া দরকার ছিল। কোথা থেকে কীভাবে … কিন্তু নামটা ওর একদম পছন্দ নয়। রুমন ডাকলে তো আরও পছন্দ নয়।

“তখন জানার কথা কী বলছিলি?” রুমন চট করে কথা ঘোরায়।

 “ওই পূর্বপুরুষদের জল দেওয়ার নিয়ম…”

“তুই দিস জল? করিস নাকি তর্পণ?”

 “ক্ষেপেছিস? জন্মেছি এক জায়গায়, বড় হয়েছি আর এক জায়গায়। মায়ের কাছে ওই দেশের গল্প যতটুকু শুনেছি, তার মধ্যে অনেক আলো আছে ঠিকই। মা অন্ধকারটুকু আড়াল করে।”

 “আমাদের বাড়িতে অনেক আলো ঈশান। তুই তো গেছিস।”

 ঈশান, যাকে অফিসে সবাই প্রকাশ্যেই মিষ্টু বলে, আড়ালে আরও হয়ত বলে কিছু, সেগুলো ধর্তব্যের মধ্যে নয়, সে রুমনের কথায় চুপ করে থাকে। রুমনের বাড়িতে একবার নয়, অনেকবারই গেছে সে। যতবারই গেছে, ওর ভেতর থেকে একটা পাপবোধ চুঁইয়ে নামে। এখানে ও দলছুট। এখানে শুধু নয়, ও বহু জায়গাতেই দলছুট। শুধু রুমনের কাছে…

 “আচ্ছা রুমন, তোদের বাড়ির আলোর মধ্যে আমাকে মানাবে?”

রুমন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তার উল্টোদিকের মানুষটির দিকে। একজন পরিপূর্ণ মানুষ ঈশান। বহিরঙ্গে তার অন্য পোশাক। এই পোশাক ছেড়ে ফেলতে চায় সে। চারপাশের বহু মানুষের সঙ্গে তার অসম লড়াইতে তার একমাত্র বন্ধু রুমন।

“কেন মানাবে না? আমাদের বাড়ির আলোর তলায় এসে নিজের সত্যিকার পরিচয়ে দাঁড়িয়ে দেখিস, সবাই তোকে আগলে রাখবে।”

“তুই কী করে জানলি? আমার তো ছেলেবেলা থেকেই কত অপমান আর যন্ত্রণার কাঁটা… কত ইঙ্গিত, ইশারা… আমার জন্য মা’কেও… আজ আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি ঠিকই। কিন্তু নিজের পরিচয় বদলে ফেলে এই চাকরিটাই কি আর করতে পারব?”

রুমন আকাশের দিকে তাকায়। নির্ভার মেঘের আনাগোনা। আকাশের ওপারে এক পৌরাণিক সাম্রাজ্যে সুর-অসুরের দ্বন্দ্ব। মানুষের মনের রাজ্যে যেমন। সমুদ্র মন্থনে উঠে আসে হলাহল। একা কমলা নিয়ে আসেন অমৃতের পাত্র। ঈশান নতুন জীবন চায়। ঈশানকে তার পছন্দের নতুন জীবন উপহার দেওয়ার জন্য পণ করেছে সে। বাধা কাটানোর মন্ত্র সে ঠিক খুঁজে নেবে।

“ঈশান, অপারেশনের অনেকগুলো ধাপ আছে। পেরোতে একটু সময় লাগবে। তারপর তোকে কী নামে ডাকব বল তো?”

“আমি নিজের নাম বদলে ঈশানী করে নেব ভেবেছি…।”

 রুমন হাত বাড়িয়ে দেয়।

“নাঃ। আমি তোকে কী নামে ডাকব জানিস? আমি তোকে ডাকব লক্ষ্মী।”

 

 

 

 

 

 

শ্যামলী আচার্য

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 thoughts on “আমায় তুমি লক্ষ্মী বলো

  1. কী ভালো লিখলে শ্যামলীদি। অবশ্য তুমি সবসময়ই অন্যরিকম এক ফ্রেম ধরার আশ্বাস নিয়েই আসো। রুমন আর ঈশান নতুন জীবনের অঙ্গীকার নিয়ে আসুক। আলোকোজ্জ্বল হোক আগামী