কমলাসনা

দেশ দেখার গল্প অথবা গল্পে দেশ দেখা

 

নন্দিনী আধিকারী

 

কমলা আর বাবুলালের বিয়ের বয়স মাত্র চারমাস। তবু যেন তাদের সুখের ঘরে দুখের ছাউনি। নতুনবিয়ের আলোয় এক বিষণ্ণতার ছায়া।বাবুলাল গোপেদের ছেলে,ভালোবেসে বিয়ে করেছে ধোবীদের মেয়ে কমলাকে। ছত্তীশগড়ী সমাজ তাদের ভালোবাসার বিয়েকে স্বীকার করেনি। তাই সমাজচ্যুত নবদম্পতির ঠাঁই হয়েছে সীতাপুর গ্রামের একপ্রান্তে।
 গতবছর বাবুলাল তুলসী গাঁওয়ের মড়ঈ  মেলায় দলবল নিয়ে রাউতনাচা নাচতে এসেছিল। দীপাবলীর পর দেও উঠনী একাদশী পরব। সেদিন বিষ্ণু তাঁর  চতুর্মাস্য যোগনিদ্রা ভঙ্গ করেন। খেতিকিষাণী করা ছত্তীশগড়ীরা চারমাস চাষের কাজে হাড়ভাঙা খাটনির পর একটু ফুরসত  পায়। রাউত বা গোপেরা গয়লার পো কৃষ্ণকে নিজেদের পরমাত্মীয় ভেবে ঝলমলে  রঙিন  পোশাক ,মাথায় মুকুট পরে নেচেগেয়ে তার
 ঘুম ভাঙায়। টিমকী, মোহরী,দফরা ,ঢোলক,সিংবাজার সুরেছন্দে কেষ্টঠাকুরের মত সুন্দর  বাবুলাল সেদিন যখন পৌরুষের শৌর্যে নাচছিল,হাতের লাঠি ঘুরিয়ে নানা কসরৎ করছিল,তখন তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না কমলা। বাবুলালও কমলার  নয়নবাণে আহত হয়ে মন দিয়ে ফেলেছিল কমলাকে । দ্বিতীয়দিন বাবুলালের  গানের কথায় ঘুরে ফিরে আসছিল,
“মোর তীর আজা রাণী
খবাহুঁ বীরো পান
কোহরা কে লোবা নারে ম সরগে
তোর বিনা হিরদে ম ভুরী বরগে”।
এরপর দুজনের গোপনে  গোঠবাত,মেলমিলাপ।  তারপর কানকীধামে বাবা কণকেশ্বরের মন্দিরে চুপিসারে বাবুলাল ধোবীদের মেয়ে কমলাকে বিয়ে করে সংসার পাতল।  দুইবাড়ির প্রবল আপত্তি,ধমকী,চোখরাঙানি মাথায় নিয়ে  ঘরছাড়া হল তারা।
টুরাটুরির সংসারে তাদের ভালোবাসার অভাব রইল না বটে,তবু তীজ-তিওহারে তাদের সঙ্গীহীন ,পরিবারবিচ্ছিন্ন মন বড় উতলা হয়।
 রাখীবন্ধনের দিনে কমলার  ভায়েদের কথা মনে পড়ে। তীজব্রতে তার বোনেদের একসঙ্গে দোলনায় ঝোলা,হাসিঠাট্টার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বাবুলালের মনখারাপ  হয়  এবছর নবরাত্রির মাতাজাগ্রাতা আর যশগীতের আসরে পরিবার থেকে সে সম্পূর্ণ  বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল।
বছরঘুরে আবার এল দীপাবলী। পরিবারের একলৌতা বেটা বাবুলালের  এইসময় কত কাজ থাকে!ঘর পোতাই করা,দীপাবলীতে লছমীপুজোর আয়োজন, তারপর গোবর্ধন পুজো, ভাইদুঝ,দেও উঠনী একাদশী আর রাউত নাচা। এই সময় বড় সুখের বাবুলালেদের কাছে। বাতাসে ধানপাকার গন্ধ।উৎসবের প্রস্তুতিতে মেতে উঠেছে গাঁয়ের মানুষ। বড় উৎসাহে ঢোল,মঞ্জীরা নিয়ে রাউত নাচের মহড়া শুরু করেছে তারা ।তারপর দলবল নিয়ে ভিনগাঁয়ে নেচে গেয়ে গলায় কত মেডেল ঝুলিয়েছে বাবুলাল!
সীতাপুর গ্রামে অবশ্য রাউতনাচার দলের  মুখিয়ার কপালে  চিন্তার ভাঁজ।  তাদের মূল নর্তক বাবুলালই যে আজ বাড়িছাড়া,সমাজপরিত্যক্ত। তার দলের মূল আকর্ষণই কানহাইয়ার মত সুঠাম সুন্দর বাবুলাল ! নাচের দল উপায় না দেখে বাবুলালের আশিবছরের বাব্বার শরণাপন্ন  হল।সে সীতাপুরের সরপঞ্চও বটে।”ওকর বুলালো বাব্বাজী”। অনেক সাধ্যসাধনার পর বাব্বাজী রাজি হল বটে তবে তার এক গোঁ, “ধোবীঘরকা টুরী কো ঝিন লেবে হমন, বাকি মোর পোতাকো ঘর বুলা লেবে”।
দলবল গেল বাবুলালের  গোঁসা ভাঙাতে। তবে বাবুলালও যে ভালোবেসে ঘরপরিবার ছেড়েছে!সেও  বলে,”কাবর ছোড়ুঁ মোর ডোওকি কো?হম না যাবে একেলে  মোর ঘর।” কমলাও তার স্বামীকে অনুনয় করে বলে,”চলো না। হমন মনা লেবে ওমন কো”।
অনেক বাগবিতন্ডা,আলাপ আলোচনার,কাকুতিমিনতির  পর  নবদম্পতির গৃহপ্রবেশ  হলেও আরতির থালা সাজিয়ে  তাদের বরণ করা হল না।  উঠোনের  এককোণে একটি ছোটো ঘরে তাদের ঠাঁই হল।
এদিকে দীপাবলীর  আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। ঘরেবাইরে এখন অনেক কাজ। কমলা খাটিয়ে মেয়ে। ছত্তীশগড়ের  মাতৃতান্ত্রিক সমাজে  মেয়েরা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে।
কমলাও কোমরে আঁচল গুঁজে লেগে পড়ল  কাজে। মাটির ঘর উজ্জ্বল  হয়ে উঠল হলুদ রঙে। দেওয়াল জুড়ে,দুয়ারে রঙবিরঙ্গী গাছ  ফুল,পাতা,প্রজাপতি, পাখির ছবি আঁকল নঈ বহুরিয়া। গোবর নিকোনো মাটির উঠোন ঝকঝকে তকতকে হয়ে উঠল
তার হাতের স্পর্শে। তুলসী মঞ্চ  সেজে উঠল রঙিন আল্পনায়।
দীপাবলীর পরই তুলসীবিবাহ। আখ দিয়ে সাজানো হবে তুলসীমঞ্চ। নতুন ফসল আখের ঢের জমা হয়েছে চাষীর ঘরে। ভগবানকে নিবেদন করেই  আখ যাবে চিনির কলে। আখের রস দিয়ে সোনা রঙের গুড় তৈরি হবে মস্ত লোহার কড়াইতে। সেসব গুছিয়ে রাখল কমলা। গোয়ালার ঘরে গোবর্ধনপুজোরও বড় মাহাত্ম্য। গোরু,বাছুর ,মোষকে স্নান করিয়ে,তেলহলুদচন্দনের টিকা লাগিয়ে পুজো করে তাদের খিচুড়ি খাওয়ানো হবে। আঙিনায় বানানো হল গোবর দিয়ে গিরি গোবর্ধন। কোনো ব্যবস্থার ত্রুটি রাখল না কমলা।
এছাড়াও গোটা আঙিনা জুড়ে  কমলার হাতের রঙ্গোলী ফুটে উঠল। ঘরের প্রতিটি কোণ মালিন্যমুক্ত হল। শাশুড়ি,দিদিশাশুড়ির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চালের গুঁড়ো,তিল,আটা দুধ,গুড়,ডাল দিয়ে সে বানালো ফাররা,বাফুলী,বাশুলী খুরমা,ঠেঠেরা,খজুর,আরো কত ব্যঞ্জন। বাবুলালের গোটা ঘর এমনি করে উৎসবের  সুগন্ধে ভরে উঠল। দীপাবলীর সন্ধ্যেয় বাবুলালের কুটির আলোকিত হল কমলার হাতের দীপমালায়।
বাবুলালের ঘরকে আপন করেও কমলার দ্বিধা,সংশয় যায় নি। নীচজাতির মেয়ে কমলা লছমীমাতার পুজোর সময় কুণ্ঠিত হয়ে সবার  পিছনে দাঁড়িয়ে রইল।তার পা সরছিল না ভগবানের আসনের কাছে যেতে।  হঠাৎই সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাবুলালের ডোকরীদাঈ  এগিয়ে এল।আরতির থালা কমলার হাতে দিয়ে   সে বলল ,”আ যা নঈ বহুরিয়া, আ যা মোর পোতা বাবুলাল,পহিলী আরতি অব তুমন উতারবে লছ্মীমাতা কি”। বাবুলালের মাটির কুঁড়েঘরে ,দীপাবলীর  আলোয় সমস্ত  অন্ধকার যেন একনিমেষে দূর হয়ে গেল। গৃহাসনে প্রতিষ্ঠিত হল কমলা।
লেখক
নন্দিনী অধিকারী
পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *