কোজাগর

কোজাগর

প্রতিভা সরকার

 

 

 

নিজের ডান দিকের ভারী স্তনটি হাতে তুলে ধরে মেয়ে। নিচটা দেখিয়ে বলে,”মা, জ্বালা!” 

জ্বালা শব্দটা তার মুখে দালার মতো শোনায়। তবে এতো দিনের অভ্যেসে সীমার বুঝতে অসুবিধে হয় না।

 সে ঝুঁকে পড়ে। তিন আঙুলের মাথায় তুলে ধরে বিশাল কাদার তালের মতো মাংস পিন্ডটির ভারসাম্য রাখে। বুকের সঙ্গে লেগে থাকা অংশটির চামড়ায় সরু সরু ফাটা, লালচে ফোলা, যেন ফোসকা মতন। চটচটে কিছু লাগে সীমার আঙুলের ডগায়। লাল হয়ে ফুলে গেছে জায়গাটা, রস গড়াচ্ছে। হাওয়া বাতাস পৌঁছয় না, জল সাবানও হয়তো স্নানের সময় লেগে থাকে, চাপা জায়গাটার তাই এমন অবস্থা! 

“শশী, স্যাভলনের শিশি আর তুলোটা নিয়ে আয় তো।” গলা তুলে কাজের মেয়েটিকে ডাকে সীমা। এমনিতেই ঘা ঘা হয়ে গেছে, খুব জ্বালা করবে স্যাভলন দিলেই, কিন্তু না দিয়েই বা উপায় কী! 

 সীমার মেয়েটি জন্ম থেকেই এইরকম। দিনে আগে একবার ফিট হতো, এখন দু’বার, তিন বার, যা খুশি তাইই হতে পারে। কথা কিছু কিছু বলতে পারে, অনেকক্ষণ ভেবে, থেমে থেমে,  কিন্তু ঠোঁট থেকে অনবরত লালা গড়ায়। বোঝে প্রায় সবই। তবে পৃথিবীর সব প্যাঁচ পয়জার সে বুঝে ফেলবে এতো কোনকালেই হবার ছিলো না, হয়ওনি। স্কুলেও পাঠানো যায়নি তাকে। বাড়িতেই অক্ষর চেনানো, গোণা, রিডিং পড়া, এই সবের অভ্যাস করাতো সীমা। কিন্তু যতই বয়স বেড়েছে মেয়ে ততই বোধ হারাতে থেকেছে, যদিও পাঁচ ছ’ বছরের বাচ্চার মতো বুদ্ধি  তার মগজে রয়েই গেছে। সেটা বোঝা যায় মাঝে মাঝে চোখের উজ্জ্বলতা, ফিকে হাসি আর দুষ্টুমি করবার অদম্য ইচ্ছে থেকে।

এখন মেয়ের বয়স গড়িয়ে গেল ত্রিশের কোঠায়। ও যদি সম্পূর্ণ সুস্থ হতো, তাহলে এই কোজাগরী সন্ধেয় ওকে দেখে যে কারো লক্ষ্মী দেবীর কথা মনে হতো। সীমার মতোই অজস্র কোঁকড়া চুল, কাটা কাটা নাক মুখ, লাল পুষ্ট ঠোঁট। কিন্তু দোহারা গড়নটা পায়নি মেয়ে। বরং বাবার মতো ভারী হাত পা বুক। হাঁটাচলা তেমন নেই বলে আরো ভারী হয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ। ঘরের ভেতরেও হাঁটে থপথপ করে। উপরন্ত সে আজকাল একেবারেই হাঁটতে চাইছে না। পায়ে ব্যথা, বলে গোঁজ হয়ে বসে থাকছে, নড়ায় কার সাধ্যি। 

এ আর এক ধরনের দুষ্টুমিই হবে বা, সীমা ভাবে, নাহলে আগে তো সে আর দেবারুণ মিলে ওকে ছাতে নিয়ে যেত। দোতলা থেকে লিফটে করে চারতলার ছাত, কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি, তারপর সিঁড়ি ভেঙে ফিরে আসা। দূরের নানা রঙের বাড়িগুলো হঠাতই কাছে চলে আসতো। শীতকালে মিহি মসলিনের চাদরের মতো কুয়াশা নামা শুরু হলে সীমা তাড়া দিতো, “চলো চলো, ওর ফট করে ঠান্ডা লেগে যাবে।” গরমকালে ঝিলের দিক থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় ভাগ্যবিপর্যয়ে সিঁটিয়ে থাকা তার প্রাণ মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে যেন জুড়িয়ে যেতো।  

মেয়ে এসব কতটা বুঝতো কে জানে, কিন্তু বাবার হাত ধরে ছাতে কয়েক পাক ঘুরে নেওয়ায় আপত্তি করেনি কখনো। মাঝে মাঝে সূর্যাস্ত দেখেছে অদ্ভুত চকচকে চোখে। সুন্দরকে দেখার মুগ্ধতা তখন ওর চোখেমুখে। আধখানা মগজে অল্প করে হলেও সবই ঠাসা আছে, সীমা ভাবে।

কিন্তু কিছুদিন বাদে একদিন নামার সময় মেয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করল, “আমি হেঁটে হেঁটে নামব না।”

মেয়ের মুখে কথাগুলো শোনালো “হেঁতে হেঁতে নাম্বনাআআ”। কিন্তু বাপ মায়ের তো বুঝতে কষ্ট হয় না। দেবারুণ তাড়াতাড়ি করে বলে,  

“বেশ তো, না নামবি, না নামবি, চল লিফটে করে নামি।”

“না, আমি বসে বসে নামব।”

সেটা আবার কী!  সীমা, দেবারুণ চোখ চাওয়াচাওয়ি করে। দেখা গেল ছাদের দরজা থেকে দোতলায় তাদের দরজা অব্দি যে ক’টা সিঁড়ি আছে, সবগুলোতে বসে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে নেমে আসা এবং ম্যাক্সির পেছনটা সিঁড়ির নোংরায় পুরো কালো করে দেওয়ার নামই বসে বসে নামা। কবে এই অদ্ভুত খেয়াল উবে যাবে, সেই ভরসায় থাকতে থাকতে তাদের ছাদে যাওয়াই বন্ধ হয়ে গেল। জোর তো করা যায় না, মেয়ের জান্তব চিৎকারে শুধু সারা পাড়া নয়, অন্তরাত্মা অব্দি কেঁপে উঠবে। 

জল মিশিয়ে স্যাভলনের ধার কমাবে বলে তুলো আগেই ভিজিয়েছে সীমা, তবু মেয়ে উঃ করে ওঠে, ধাক্কা দিয়ে মায়ের হাত সরিয়ে দিতে চায়। বলে, দালা দালা। সীমা থপ থপ শব্দ করে তুলো ছোঁয়ায় দুই বুকের নিচেই। মুখে বলে, “এই তো হয়ে গেল!  আর একটু, আর একটু।” মেয়ের গলা বেয়ে উঠে আসা কষ্ট ও ভয়ের আওয়াজ একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে ভয়াবহ বিস্ফোরণের মতো বিকট কান্নায় ফেটে পড়ে। 

সীমা বলে, “চুপ, চুপ। চ্যাঁচাস না। এখুনি হাঁড়িচাচা আসবে। টুপ করে ঠোঁটে তুলে নিয়ে যাবে হুইইই হোথায়।”

সীমা যতদূর পারে হাত তুলে দেখায়। তাতে একটু কাজও হয়। মেয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে, যেন দূরত্বটা মাপে আর থেকে থেকে ফুঁপিয়ে ওঠে। ফোঁপানি তবু চলবে, কিন্তু গলা একটু উঠলেই পাশের বাড়ির মাসিমা, কড়া নেড়ে বলবেন, “এভাবে কি থাকা যায়! ও যা চায়, তাই করলেই তো পারো, বাপু।”

যেন মেয়ের জন্য খুব দরদ,কিন্তু সারা পাড়ায় ইনিই সীমার “ন্যালাখ্যাপা” মেয়ের জন্য তাদের কতো ঝামেলা হয়, সেটা অক্লান্ত রটিয়ে বেড়ান। সীমা তটস্থ হয়ে যায়, “আপনাদের দিকের জানালা আমি সব বন্ধ করে দিচ্ছি মাসিমা।”  

দেবারুণ প্রথম প্রথম বিব্রত হতো মেয়ের এইসব গোপন পরিচর্যা তার সামনে করা হলে। শুধু তো ফোসকা নয়, কিভাবে প্যাড পরিয়ে দিলে সেটা যথাস্থানে রাখতে হয়, সেটাও সীমাকে এখনও প্রত্যেক মাসে পইপই করে বোঝাতে হয়। 

এখন এসব শেখাবার তোড়জোড় দেখলেই দেবারুণ শান্তভাবে বাইরের ঘরে চলে যায়। বাবা হয়ে কী করে সে এইসবে অংশ নেবে ভেবে ঠিক করে উঠতে পারে না যেন। তার থেকে খবরের কাগজে মুখ ঢেকে নেবার অভ্যাস করাই ভালো। আর সেই অভ্যাস এখন এমন পোক্ত হয়েছে যে কাগজ চোখের সামনে মেলা থাকলে কালো কালো শব্দ ছাড়া সে আর কিছুই দেখতে পায় না। মেয়ের কান্নার আওয়াজ, সীমার বকাবকি বা সান্ত্বনা, কিছুই তার কানে পৌঁছায় না। 

কিন্তু তাতে তো সবটা মেটে না। আরো কিছু কাজ তাকে বয়স্ক মেয়ের জন্য করতে হয়, যেগুলো বাবারা সাধারণত করে না। যেমন মেয়েকে কমোড থেকে তুলে নিয়ে আসা। ঐ স্বাস্থ্যের মেয়েকে, যে হাঁটতে অনিচ্ছুক, অথচ নানা ওষুধের সাইড এফেক্টে প্রবল কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে যাকে দিনে তিনবার টয়লেটে গিয়ে বসতে হয়, তাকে ধরে ধরে নিজের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা সীমা অথবা লক্ষ্মীর পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে সে কাজটা দেবারুণকেই করতে হয়। সীমা অবশ্য বলে দেবারুণ আর একটু কড়া হলে মেয়ে একাই উঠে আসতো। হয়তো কোনোদিন বাবা বাড়ি নেই, মেয়ে কিছুতেই একা কমোড থেকে উঠে আসবে না জেদ ধরেছে, সীমা নাকি গম্ভীর গলায় বলে, “তাহলে চললাম আমি। তুমি বসে থাকো, কিন্তু জানালা দিয়ে ঢোকা পেঁচা ঠুকরে না দেয়!”

উঠতে গিয়েও জেদি মেয়ে বসে পড়ে, তারপর যখন দরজার বাইরে তাকিয়ে থেকে থেকে বোঝে, সত্যি সেখানে বাপ দাঁড়িয়ে নেই,বাপের ছায়াও নেই, তখন আপনিই উঠে পড়ে। মা একটু হাতটা ধরে থাকলেই দিব্যি থপথপ করতে করতে নিজের ঘর অব্দি পৌঁছে যায়। “তুমিই ওকে এতো বাড়িয়েছ।” সীমা রাতে শুয়ে দেবারুণকে বলে, “এতো আতুপুতু কর বলে ও আরো লাই পেয়ে যায়।” 

এখন আর নিরিবিলি কথা বলার এই বেশি রাতের যৌথ শয্যার আড়ালটুকুও নেই। মেয়ে তাদের একসঙ্গে শুতে দেবে না মোটেই। বাবা ওর ঘরে শোবে, আর মায়ের কথা উঠলেই রান্না ঘরের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেবে। “আমার ওপর তোর এতো রাগ কেন রে” সীমা জিজ্ঞাসা করলে চোখ বড় বড় করে মেয়ে তাকাবে, যেন সে কতো রেগে গেছে। “তুমি কাল মারলে কেন আমাকে” প্রচুর লালা ছিটিয়ে রাগত মুখে মেয়ে কষ্ট করে বলতে পারে। 

মাঝে মাঝে হাত উঠে যায় সীমার। পরে যদিও খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কতো আর সহ্য করবে সে। ত্রিশ বছর মানে অনন্ত সময়। সে আর মা হতে চায়নি । পরে অন্য এক ডাক্তার যদিও বলেছিল, জন্মের সময় ফরসেপ বাচ্চার মাথার দুপাশে গভীর হয়ে বসাতেই এই বিপত্তি, তবুও সে আর সাহস করে উঠতে পারেনি। যদি পরের সন্তানটিও কোনো কারণে এইরকম হয়! যদি তার অথবা দেবারুণের শরীরের অনেক গভীরে, কোনো রক্তকণিকার কেন্দ্রে ঘাপটি মেরে বসে থাকে এই অনর্থ ! থাক বাবা, দরকার নেই। 

দেবারুণের মনে কী ছিলো জানে না সীমা। কিন্তু নির্বিরোধ স্বভাবের দেবারুণ কোনো তর্কে না গিয়ে সবটা মেনে নিয়েছে। আর মেয়েকে সে ভালবাসে সবার থেকে বেশি। পাছে নতুন কেউ এলে মেয়ের অযত্ন হয়, এই ভয়টাও তার মনের কোণে থেকে থাকবে কোথাও। 

মেয়ে জেদ করছে দেখে তাদের শয্যা, এমনকি ঘর অব্দি আলাদা হয়ে গেল। মেয়ের ঘরে আলাদা খাটে দেবারুণ, পাশের ঘরে সীমা। তবে মাঝের দরজা খোলা থাকে, নাইট ল্যাম্প জ্বলে, সীমা মাথা তুললেই দেখতে পায় বাবা নামের ট্রফিটাকে জয় করে মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, দেবারুণেরও নাক ডাকছে সশব্দে।  

কয়েক দিনাগে রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে সীমা দেখলো মেয়ের বিছানা শূন্য। তার কন্ঠার কাছে প্রাণ লাফ দিয়ে উঠে এসে তিরতির করে কাঁপতে লাগলো, যে মেয়ে হাঁটতে পারে না তেমন, সে এই মাঝরাতে কোথায় গেল! 

লাফ দিয়ে উঠে এ ঘর ও ঘর করে সীমা মেয়েকে আবিষ্কার করলো টয়লেটে কমোডের ওপর স্থিত। যেন ধ্যান করছে।

“তুই অন্ধকারে একা এলি কী করে!” 

“হেঁতে হেঁতে”, মেয়ের জবাব।

“হেঁটে হেঁটে! হাঁটতে পারিস তুই! ডাকিসনি কেন?  যদি পড়ে যেতিস!”

“তুমি তাহলে বলো আমাকে কাল মাথিমার বাড়ি নিয়ে যাবে।”

কাল মাসিমার বাড়ি কালিপুজো। সঙ্গে লক্ষ্মীদেবী এবং তার বড় বোন অলক্ষ্মীদেবীর পুজো। নিমন্ত্রণ করতে এসে মেয়ের সামনেই মাসিমা বার বার বলে গেছেন সীমা যেন মেয়েকে ফেলে না যায়। পাশেরই তো ফ্ল্যাট। অসুবিধে কী! 

অনেক উৎসুক, করুণা-মাখা দৃষ্টি, নানা প্রশ্ন, মেয়ের হাঁটাচলা, কথা বলার বীভৎস অনুকরণ, এসব এড়িয়ে যেতে চায় বলে সীমা উৎসবের বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে যেতে চায় না। সে “আচ্ছা দেখা যাবে” বলে কাটিয়ে দিতে চাইছিলো। কিন্তু এখন স্বয়ং মেয়ে বেঁকে বসেছে। তাকে না নেওয়া হলে সে নানা অপকর্ম করবে, একা অন্ধকারে টয়লেটে চলে যাবে। কিন্তু ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে অজ্ঞান হবেই, দাঁত দিয়ে নিজের জিভ কামড়ে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টাও করতে পারে। এসবই তার রোগ লক্ষণ। তাকে সুস্থ করে তুলতে তখন পাক্কা দু থেকে আড়াই ঘন্টা। 

সীমা মেয়েকে তাই স্নানের সময় সাবান ঘসে ঘসে স্নান করালো। এতো ঘন চুল, শ্যম্পু করলে যতই কন্ডিশনার লাগাও না কেন, শুকিয়ে তেল মাখাতেই হবে। নাহলে আঁচড়ানো যাবে না। একটা কালো লং স্কার্ট আর ওপরে রাণী কালারের শর্ট কুর্তা। কপালে ছোট একটা টিপ। জেদ করে চোখে ঘন করে কাজল পরে মেয়ে,যদিও সীমার ইচ্ছে ছিল না, কারণ ওর চোখ দিয়ে আজকাল খুব জল পড়ে। সাজিয়েগুছিয়ে মেয়েকে বললো, “পুজো দেখতে নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু। একদম দুষ্টুমি করা চলবে না। চেঁচামেচি, অবাধ্যতা কিচ্ছু না!”

উৎসাহের আতিশয্যে মেয়ে স্কার্টে পা বেঁধে পড়ে যাচ্ছিলো, ভাগ্যিস সময়মতো ধরে ফেলতে পারা গেছে। সীমা চোখ বড় বড় করে, “কী বললাম তোকে পইপই করে! লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমার হাত ধরে থাকবি।” তারপর কী ভেবে শশীকে ডেকে বললো মেয়ের ওড়নাটা দিয়ে যেতে। হুইল চেয়ারে বসিয়ে বুকের ওপর পাট করে সাজিয়ে দিলো সেটা। 

কালীপুজোর প্যান্ডাল ছাতে। পিটুলি দিয়ে বানানো লক্ষ্মী ঘরে পূজিত হচ্ছেন, অলক্ষ্মী বারান্দার এক কোনায়। মাসিমার নাতি নাতনি তাদের বন্ধুদের নিয়ে কী বিকট অলক্ষ্মী বানিয়েছে! মাটি দিয়ে তৈরি এক স্থূলাঙ্গী, বিশালস্তনী। চোখের জায়গায় দুটি বিরাট কড়ি। গলায় জবা ফুলের মালা, থ্যাবড়া মুখে গোবর আর ছাই লেপা। মাথায় চুলের জায়গায় ঝাঁটার কাঠি গোঁজা। বিকট মূর্তি দেখে মেয়ে সীমার হাত চেপে ধরে, “ভয় কচ্ছে।” 

অলক্ষ্মীর গল্প সীমা জানে। সমুদ্র মন্থনে লক্ষ্মীদেবীর আগেই উঠে আসায় অলক্ষ্মী তার বড় বোন বলে বিবেচিত হয়। প্রবল ক্রোধী, কামাতুরা এই দেবী লক্ষ্মী নারায়ণের প্রেমযাপনে ভীষণ ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ায় লক্ষ্মী তাকে সর্ব সর্বনাশের অভিশাপ দেন। তাকে বিতাড়িত করে গৃহস্থ সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বর চায় তার ছোট বোনের কাছে। 

বাচ্চারা কাঁসর ঘন্টা বাজাতে বাজাতে অলক্ষ্মীকে বাইরে দূরে তেমাথার মোড়ে অনাদরে বিসর্জন দিতে যাচ্ছিলো আর হুইল চেয়ারে বসা মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল। লালা পড়ে গলায় বাঁধা রুমাল ভেসে যাচ্ছে, চোখে ধেবড়ানো কাজল, তার কিছুটা হাতের ওপরেও লেগেছে। এক কিশোর ভাঙা গলায় কাকে যেন জিজ্ঞাসা করল, “আই বাপ, এটা কে রে!” কাঁসর ঘন্টা ছাপিয়ে উত্তর এলো,”অলক্ষ্মী। দ্যাখ না কতো মিল।”

রাতে খাওয়া হলে মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। কী বুঝেছে সে কে জানে, পুজো বাড়ি থেকে সঙ্গে আনা প্রসাদ ছুঁয়েও দেখল না। ঘ্যান ঘ্যান করছিল সারাক্ষণ। ঘুমিয়ে পড়তে সীমা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দেবারুণের বিছানায় বসে সে নীচুস্বরে আজকের বিশ্রি অভিজ্ঞতার কথা বলছিল, আজকালকার বাচ্চারা কতো নিষ্ঠুর হয়, এমপ্যাথির কতো অভাব তাদের মধ্যে! 

দেবারুণ হঠাৎ বলল, “বাচ্চারা চিরকালই তাই। মনে আছে স্কুলফেরত ফড়িং ধরে একটি একটি করে তার ডানা ছেঁড়ার নিষ্ঠুরতার কথা?”

“তাই বলে একটা অসুস্থ মেয়েকে… তার মায়ের মুখের ওপরে…”

“দুনিয়াটা এইরকমই সীমা। কেন যে এখনও তুমি দুঃখ পাও…”

দেবারুণ সীমার আঁচল দিয়েই সীমার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছিল, হঠাৎ মেয়ের চিল চিৎকারে দুজনে ছিটকে দুপাশে সরে যায়। ঘুম ভেঙে গেছে মেয়ের, বাবা মা-কে ঘনিষ্ঠ দেখে তার মাথার ঠিক নেই। সীমাকে সে যেন দূর থেকে উত্তোলিত  বাঁকানো তর্জনীতে বিঁধে রেখেছে, আর আলুথালু ত্রস্ত ক্রুদ্ধ তাকে দেখে মনে হচ্ছে মানুষের ছায়ার মতো অথচ মানুষ নয়, এইরকম কোনো অতিপ্রাকৃত জীব। সেইরকম দুর্বোধ্য গোঙানির মতো করে সে মা-কে দেখিয়ে বলে চলেছে, অলক্ষ্মী, অলক্ষ্মী। 

সীমার সমস্ত শরীর যেন শিউরে উঠল। দশ মাস এই মেয়েকে সে জঠরের অতি গভীরে তিল তিল করে মানুষের রূপ দিয়েছে। নিজের কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও, চিকিৎসা বিদ্যার কী এক গুঢ় সাময়িক ব্যর্থতার জন্য রূপবতী সন্তানটি তার বুদ্ধিহীন হয়ে জন্মালো। কিন্তু তাতে তাকে কেউ রেয়াৎ করেনি। শাশুড়িও আড়ালে তাকে অলক্ষ্মী বলেই ডাকতেন। আত্মীয় বন্ধুরা বড় বেশি করুণা করে তাকে, দেবারুণকে। গতরাতের মতো অকারণ হয়রানিও লেগেই আছে। তবু এই গভীর রাতে ঘরে জ্বলা টিমটিমে নাইট ল্যাম্পের আলো মেয়ের কালো কোঁকড়া চুলে পিছলে যাচ্ছে দেখে তার মন কী এক সুধায় ভরে ওঠে, দুহাত তুলে সে এগিয়ে যায় চোখের জল আর মুখের লালায় নাকানিচোবানি খাওয়া শাবকের দিকে। 

“মা মাগো, মা লক্ষ্মী আমার, সোনা মেয়ে, কাঁদে না মা… ” দুই হাত মেলে দেয় সে মেয়ের দিকে, যেন ডানা মেলা পক্ষীমাতা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিছানার ওপর মেয়ের পায়ের কাছে, যেন বাধ্য পেঁচকটি, “ভালবাসি মা তোমাকে আমরা, তুমিই তো আমাদের ঘরের লক্ষ্মী! তুমি ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই মা!”

সত্যিই তো এই তুচ্ছ সংসারের একেবারে কেন্দ্রে বসে আছে এই ছোট মেয়েটি, তাকে ঘিরে সব ঢেউ নামে আর ওঠে। 

 মেয়ের গ্রীবায় এবার অহংকার ফুটে ওঠে। যেন অলক্ষ্মী বদনাম ঘুচিয়ে এবার সে স্বমহিমায় স্থিত। চোখ পিটপিট করে হাসে সে বাপের দিকে তাকিয়ে। দেবারুণ উঠে এসে বিছানায় মেয়ের একদিকে বসে, সীমা আর একদিকে। দুজনের হাত দুদিক থেকে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে, তখনও তাদের মনে জেগে থাকে কী এক আলো। অবোধ শিশুর মতো মেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দুজনকে দেখে আর খিলখিল করে হাসে, বলে “লক্ষ্মী লক্ষ্মী!”

বাইরে অবশিষ্ট কোজাগরীর আলোয় পৃথিবী ভেসে যায়। 

 

প্রতিভা সরকার

 

 

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 thoughts on “কোজাগর

  1. কি মধুর সমাপন! বেদনায় ভরে যাচ্ছিল মনটা, শেষটুকু মন ভরিয়ে দিলো৷ চমৎকার ছোট গল্প৷

  2. যথারীতি, প্রতিভা দি তাঁর মানবিক রুপে প্রতিভাত হলেন এই সুন্দর লেখার মাধ্যমে। প্রতিভাদি সাহিত্যের লক্ষী হয়ে উঠে এলেন। 🧡❤️💚💙

  3. জীবনকে কতোভাবে যে দেখা যায়!
    সুন্দরকে জাগিয়ে তোলাই শিল্পীর এক মাত্র ব্রত।
    এই লেখাটি আবার সেই কথা মনে পড়িয়ে দিলো..

  4. পড়ে বেশ কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে থাকলাম । খুব দরদী এবং অতীব বাস্তব কলম ।