লক্ষ্মী –সেই নারীসুলভ ধোঁয়াশা

লক্ষ্মী –সেই নারীসুলভ ধোঁয়াশা

শর্মিষ্ঠা দাস

 

 

 

হাত পা মেলে ধরে ওরা । আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে হাজা –পুঁজ রক্ত চুইয়ে পড়ছে । সহস্র চির ধরা ফাটা হাত পা , কালো ভাঙা নখ । হাঁটু পর্যন্ত চুলকুনি বা দগদগে ঘা । মুখ কালো , কোটরগত চোখ । কষ্টের কথা বলার জন্য মোটা  শুকনো ঠোঁট ফাঁক করতেই বেরিয়ে পড়ে –বৃষদন্ত । শাস্ত্রে ঠিক অলক্ষ্মী দেবীর বর্ণনা যেমন ।  এরা সব আমার  আশ্বিন মাসের গোড়ার দিকের রোগিনী । সবে বর্ষা গেছে তো । বাদল দিন এলে , প্রথম কদমফুল ফুটল কি না ফুটল দেখেই  এরা মাঠে ধান পোঁতা শুরু করে ।  বীজতলা থেকে ধানের চারা তুলে আনে । নব বরষায় বাংলার মাঠে প্রান্তরে চোখ পড়লেই হাজার বছর ধরে সেই এক দৃশ্য —  সকাল থেকে সন্ধে  এক ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে কাজ করে মেয়েরা । কোমর সামনে ঝুঁকে ,  গোড়ালির উপর দুই পায়ের  অনেকখানি কাদায় ডুবে –এক হাতে ধানের চারার গোছা আর এক হাত রোপণে  সদাব্যস্ত । একাজ শুধু মেয়েরাই করে । একটানা অনেকদিন জল কাদার ছোঁয়া  কি আর হাত পা নখের সহ্য হয় ! রোদে পুড়ে মুখের চামড়ার অবস্থাও তথৈবচ । কষ্ট সয়ে সয়ে দুটো টাকা আঁচলের খুটে বেঁধে যখন তারা ওষুধ নিতে আসে তখন আশ্বিন মাস । কদিন পরেই পূর্ণিমা –কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো । প্রাচীন বৈদিক মহাশক্তি লক্ষ্মী ক্রমশ ধনশক্তি আর শ্রী এর প্রতীক হয়ে গেছে ।  মাটির লক্ষী পিতিম বল আর সরায় আঁকা টানা চোখের পটের লক্ষ্মী ঠাকরুণ–কারো সঙ্গেই এদের চেহারা মেলে না ।  মেলে সেই শাস্ত্রের অলক্ষ্মী , নৈর্ঋতা দেবীর সঙ্গে । সমুদ্রমন্থনে কালকূট বিষ থেকে নাকি তার জন্ম । আর কটা দিন পর কার্তিকী অমাবস্যায় , দীপাবলীর দিন গোবর দিয়ে তার মূর্ত্তি বানানো হবে– গায়ে চুল জড়িয়ে কালি লেপে যতদূর কুচ্ছিত করে গড়া যায় । উঠোনের কোণে নম নম একটু পুজো করে- ঝাঁটা মেরে , কুলো পিটিয়ে তাকে রাস্তায় ফেলে আসা হবে । অলক্ষ্মী বিদায় ।
সেই যে তারা চারা রুয়েছিল –সেই মাঠে এখন সবুজ ধান আর শরতের হাওয়া মিলে আগামী শষ্যের সম্ভাবনা নিয়ে   আলোচনা করছে । ধান উঠবে । নবান্নে পৌষ লক্ষ্মীর পুজো হবে । ঘরে ঘরে পিঠে পুলি পায়েসের ধুম হবে । তাদের সেদিনও অন্য কাজ থাকবে –হয় একশো দিনের কাজে ঝোপঝাড় কাটা , নয়তো মাথায় ইঁট বওয়া । এইসব অলক্ষ্মীদের রোপন করা ধানক্ষেত থেকে সুগন্ধি চাল উঠবে –গোবিন্দভোগ বা রাঁধুনিপাগল ।
কোনো এক গাঁয়ের বধূ –যাকে অনেকদিন আগে সবাই “লক্ষ্মী মেয়ে ” বলে দেগে দিয়েছিল –সেই খোলস ছেড়ে যে আর কোনোদিন বেরোতে পারেনি -সে কোঁকড়া চুলে ঘেরা কপালে ঘোমটা টেনে , সেই চালগুঁড়ো দিয়ে পিঠে করতে বসবে । আগুনের আঁচে তার পানপাতা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমবে ।  হাতা থেকে গোলা ঢালবে –গোল করে ছড়িয়ে দেবে তাওয়ার উপর , নতুন গুড় নারকেলের পুর দিয়ে নিঁখুত ভাঁজে ওল্টাবে । থালার উপর স্তুপ হয়ে উঠবে ।  ছোট ছেলেটা যদি বায়না করে একটা দেবে হাতে । বাকিগুলো প্যাকেট বন্দী করে রাখবে –স্বনির্ভর গোষ্ঠির  দিদিরা এসে দাম দিয়ে নিয়ে যাবে ।  ছাদে বিউলির ডালের বড়ি শুকোতে দেওয়া আছে –এর পরে সেসবও তুলে প্যাকেট করতে হবে ।  লক্ষ্মী বউ জানেনা কোথা দিয়ে “ভেসে যায় ধনপতির ডিঙা ভেসে যায় চলতি বেলার আলোছায়া ” — এই বউ সেই হিসেবের আওতায় পড়ে না –যেখানে দেখানো হয় এদেশে মহিলা উদ্যোগপতির হার শতকরা কুড়ি । তবু ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ হয়ে  অভাবের সংসারে দুটো কড়ি আনে ।
ষাট সত্তরের দশকের আগে ঘরে ঘরে সেইসব “লক্ষী মেয়ে” দের নির্মাণ করা হত যারা গলা তুলে কথা বলে না , ধুপধাপ করে চলে না ,সাতসকালে উঠে মুখ বুজে ঘরের কাজ করে , সাত চড়েও রা নেই ।
শুধু এদেশে নয় , বিদেশেও পুরুষতন্ত্রের সুবিধার খাতিরে এই ধরনের  কনসেপ্টকে মহিমান্বিত করার যথেষ্ট চল ছিল । মনু থেকে ফ্রয়েড –সবাই জনপ্রিয় হয়েছেন নারীকে এক বিশেষ সংজ্ঞায় বেঁধে । ভাগ্যে কিছু অলক্ষ্মী মেয়ে জন্মেছিলেন , তাই আজকে নভোচারিনীরা আর ব্যভিচারিনী নন । সাহস করে , ১৯৬৩ সালে আমেরিকান লেখিকা বেটি ফ্রিডান তাঁর “The Feminine Mystique ” বইতে  ঠিক এই “লক্ষ্মী মেয়ে” নির্মাণ ব্যাপারটাকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন ।
চাল গুঁড়ো দিয়ে ধানের ছড়া শঙ্খলতা আলপনা, দুয়োরে আঁকা লক্ষ্মীর পা , তিলের নাড়ু –নারকেল নাড়ু – কলার বাকলে তেল সিঁদুরে মঙ্গলচিহ্ন –এসব বঙ্গজীবনের ঐতিহ্যের নক্সিকাঁথা । “আঁকিলাম পদ দুটি তাই মাগো নেব লুটি / আঁকিলাম পিটুলির গোলা আমার হোক সোনার বালা ” এসব সংস্কৃতি । সংস্কৃতি একঘেয়ে আটপৌরে যাপনের গায়ে  নান্দনিক জামা পরিয়ে দেয় । কিন্তু সংস্কৃতির হাত ধরে যদি সংস্কার আসে আর তার আগে যদি একটা ‘কু’ বসে তা ভয়ানক । এখনো যাঁরা বিষ্যুদবারে দুলে দুলে লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়েন — পাঠের সময় কথাগুলো তলিয়ে ভাবেন কি ! গৃহিনী ভোরে সবার আগে উঠে ঘর ঝাট উঠোনে গোবর ছড়া না দিলে , বেলা পর্যন্ত ঘুমোলে, স্বামীর আগে খেলে — মা লক্ষ্মী কুপিত হয়ে সেই গৃহ ত্যাগ করে চলে যাবেন  !  এইসব ভয় দেখিয়ে রীতিমতো  ব্ল্যাকমেল করে মেয়েদের খাটিয়ে নেওয়া । ছত্রে ছত্রে মেয়েদের অবদমনের ধান্দাবাজি ।   তা –ওইসব ‘কু’ কে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে  আজকের মেয়েরা সরস্বতীর হাত ধরে লক্ষ্মীকে সদর দরজায় বেঁধে ফেলেছে –ইচ্ছেমতো পোশাক আসাক কেনা কাটা , সিঙ্গল লিভিং , সোলো ট্রিপ কি নয় !
 লক্ষ্মী আর অলক্ষ্মী –দুই বোনে কি তাহলে এবার  মিটমাট হল ?
শর্মিষ্ঠা দাস 
পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *